স্নোপিয়ার্সারঃ ট্রেনের মধ্যে শ্রেণি সংগ্রাম আর বিপ্লব Share Tweetসম্প্রতি নেটফ্লিক্সে বং জুন হো'য়ের ডিস্টোপিয়ান এ্যাকশন থ্রিলার স্নোপিয়ার্সার(Snowpiercer) সিনেমাটির টিভি সংস্করণ মুক্তি পায়, যেটিতে শ্রেণিভিত্তিক সমাজের সংগ্রামকে খুব শক্তিশালীভাবে রূপকার্থে দেখানো হয়েছে। স্টিভ জোনস সেটা নিয়ে আলোচনার জন্য মূল সিনেমার দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন।২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া কোরিয়ান পরিচালক বং জুন হো'য়ের 'প্যারাসাইট' সিনেমাটি আধুনিক কালের পুঁজিবাদের একটি নির্মম স্যাটায়ার ছিল। এই সিনেমাটি মুক্তির পরেই ক্রিটিকাল আর কমার্শিয়াল প্রশংসা কুড়িয়ে নেয়, জিতে নেয় একগাদা পুরস্কার; যার মধ্যে অস্কারে শ্রেষ্ঠ সিনেমার মর্যাদাও আছে।ছয় বছর আগে বং স্নোপিয়ার্সার নামে আরো বেশি স্পষ্টবাদী পুঁজিবাদবিরোধী একটি ছবি তৈরি করেছিলেন, যেটি নেটফ্লিক্সের টিভি রিমেকের কারণে নতুন করে আবার দর্শকের মনোযোগ কাড়ছে।স্নোপিয়ার্সার দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্মিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবির একটি, যার বাজেট ছিলো আমেরিকান ডলারের হিসাবে ৪০ মিলিয়ন।এটিতে কোরিয়ান এবং আমেরিকান/ব্রিটিশ শীর্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করেছে । তাদের মধ্যে ছিলো সং ক্যাং হু, কো আসাং, এড হ্যারিস, টিলডা সুইনটন এবং জন হার্ট (মৃত)। 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা' খ্যাত ক্রিস ইভান্স এর প্রধান চরিত্রে ছিলেন।সশস্ত্র রক্ষীরাএই সিনেমাটি কল্প-বিজ্ঞান ঘরানার। এটি ১৯৮২ সালে প্রকাশিত গ্রাফিক উপন্যাস Le Transnerceneige অবলম্বনে নির্মিত। এটি একটি নিকট ভবিষ্যতের গল্প যেখানে দেখা যায় জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য পৃথিবী এক নতুন বরফ যুগে প্রবেশ করেছে। যারা জীবিত আছে তারা একটি বড় ট্রেনে আটকে গেছে। যে ট্রেনটি এক গোলাকার চক্রপথে বরফ আচ্ছাদিত পৃথিবীতে ঘুরতে থাকে।ছবিটার মূল বিষয়টি বেশ আজগুবি মনে হলেও, এর একটি উদ্দেশ্য আছে। আমরা এখানে সেটাই দেখার চেষ্টা করবো।২০৩১ সাল, ট্রেনটি শ্রেণীর ভিত্তিতে আলাদা হয়ে পড়েছে, গুটিকয়েক ধনীরা আছে সামনের সারিতে, অন্যদিকে পেছনের সারিতে থাকে গরীব জনসাধারণেরা। তারা খুবই জঘন্য অবস্থার মধ্যে থাকে এবং তারা ট্রেনের সশস্ত্র রক্ষীদের দ্বারা অনবরত হয়রানির শিকার হতে থাকে।সকলেই ট্রেনের মালিক উইলফোর্ডের (Harris) ব্যাপারে কথা বলতে থাকে কিন্তু কেউই তাকে দেখেনি- এখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই সে ছায়ায় জাদুকর বনে থাকে।যাই হোক, সবাই তার নিষ্ঠুর নারী ভৃত্য মিনিস্টার ম্যাসনের কথা জানে, এ ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করে সুইনটন।ট্রেনে কার্টিসের (ইভান্স) নেতৃত্বে একদল বিদ্রোহীরা ম্যাসনকে পরাস্ত করে ব্যবস্থায় রূপান্তর আনার জন্য বিপ্লবের উদ্দেশ্যে সংগঠিত হতে থাকে। ওরা যখন বুঝতে পারে যে সেইসব সসস্ত্র রক্ষীদের আসলে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রই নেই, তখন লড়াই চলতে থাকে।এটা খুব জলদিই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মিথ্যার উপর ভর করে পুঁজিবাদীরা পুরো ট্রেনটিকেই আটকে রেখেছে।কিন্তু তাদের এক গোপন ভয়ানক পরিকল্পনা থাকে এবং যার মাধ্যমে তারা এই বিদ্রোহকে ব্যবহার করে ফের প্রভাব খাটাতে চায়।সিনেমাটি একইসাথে কল্প-বিজ্ঞানির্ভর একশন সিনেমা হিসেবে ভালো কাজ করে। অনবরত মারামারির দৃশ্য, টুইস্ট এবং দ্বৈত-মিশ্রণের সাথে ক্রমে ক্রমে প্রচ্ছন্নভাবে অভিজাতদের শাসনের বিপরীতে প্রতিরোধের ঘটনা চলতে থাকে। দর্শকরা এমন ধারার সিনেমার সাথে আগেই পরিচিত।গিটারের তার বেজে উঠাছবিটিতে একশন-থ্রিলার এবং শৈল্পিক সামাজিক ভাষ্য-এই দুই ভিন্ন ধারার প্রচেষ্টা দেখা যায়।হয়তো, এই প্রচেষ্টার কারণেই ছবিটি প্রথম মুক্তিতে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। যদিও কোরিয়া এবং চীনে খুব ভালোই চলেছিল।আমেরিকায় ছবিটির পরিবেশক Weinstein Company- এর ২০ মিনিটের দৃশ্যায়ন কেটে দেয় (বিদেশি লম্বা ছবির ক্ষেত্রে আমেরিকান পরিবেশকদের এটি খুব সাধারণ বৈশিষ্ট্য) এবং নতুন ছবিটি মাত্র আটটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। বং জুন হো’ খুব সাহসিকতার সাথে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং পরবর্তীতে নতুন পরিবেশকের অধীনে পুরো ছবিটি ১২৬ মিনিটই প্রদর্শিত হয়।স্লোপিয়ার্সার খুব জলদিই ডিভিডি এবং অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে পাওয়া যেতে শুরু করে- অন্য অনেক কাল্ট ছবির মতোই-দর্শকেরা এই মাধ্যমেই ছবিটিকে বেছে নেয়।অবশ্য এর রাজনৈতিক বিষয়বস্তর জন্যই এটি সবার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলো। এমনকি সেই সমস্ত মানুষদের মধ্যেও যারা সচরাচর এই ধরনের সিনেমা দেখে না । প্যারাসাইটের সাফল্যও এক্ষেত্রে বিবেচ্য হতে পারে।নেটফ্লিক্স এখন এই সিনেমাটির অবলম্বনে একটি টিভি সিরিজের প্রচার শুরু করেছে ।এখানেও শ্রেণি সংগ্রাম,বিদ্রোহ এবং প্রতিক্রিয়ার বিষয়বস্তু গুরুত্ব সহকারে ফুটে ওঠেছে। সন্দেহ নেই, গত বছরে পৃথিবী জুড়ে সংকট এবং ঘটে যাওয়া গণ সংগ্রামের রেশ ধরে ছবিটি এখন বর্তমানে দর্শকদের মধ্যে গিটারের তারের মতোন আঘাত করবে।যারা সিরিজটি দেখতে দেখতে নিজেদের খুঁজে পাবে তাদের পিছন ফিরে ২০১৩ সালে নির্মিত আসল ছবিটিও দেখা উচিত। যদিও এই শৈলীর মিশ্রণ অনেকসময় কাজ করে না, তবুও স্নোপিয়ার্সার একটি অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং দারুণ নৈপুণ্যের ছবি যেটি আসলেই পুনরায় আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে।