বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণ Share Tweetবাঙলাদেশের ট্রটস্কিপন্থী দল গনতান্ত্রিক মজদুর পার্টির (ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স পার্টি) পক্ষ থেকে বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ঐতিহাসিক বিকাশের একটি বিশ্লেষণ আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো। লেখাটি লেখা হয় ২০০১ সাল নাগাদ এবং পাঠানো হয় আরো পরে, তাই ২০০৫ সালে প্রকাশিত।[Translated by Fahim Hasan]ইতিহাসের পুর্নলিখন শুরু হয়েছে। ৩০জুন(২০০০) মণিসিংহের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সিপিবি (বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) একটি স্মরণসভার আয়োজন করে। সাম্প্রতিক সময়েও ২৭ জুলাই, ২০০১ থেকে মণি সিংহের ১০১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আরো কিছু আলোচনা সভার আয়োজিত হয়। ঢাকার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনের বড় বড় পন্ডিতরা সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতি বরাবরের থেকে বেশিই ছিলো। গত বছর (২০০০ সালে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর এ বছর (২০০১ সালের অক্টোবরের আগে) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান লতিফুর রহমান উক্ত আলোচনা সভায় শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান।ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা থেকেই মণি সিংহ বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, নিজের লালিত জীবনাদর্শের জন্যে জীবনে নানান ব্যক্তিগত কষ্ট ও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন সহ্য করেছেন। বাম রাজনীতির এমন অনন্য ব্যাক্তিত্বকে নিয়ে অনেক প্রশংসা বাক্যই বলার আছে। তবে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের জীবনকে রোমান্ঞ্চকরণ এবং বিভিন্ন অলংকারে ভূষিত করার ব্যাপারটা বুর্জোয়া সার্কেলেই মানানসই, কিন্তু বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা খুবই বিপজ্জনক।মণি সিংহ স্মরণে এই আলোচনা সভা তার রাজনৈতিক সততা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে। বর্তমান সিপিবি নেতৃত্ব তার রাজনৈতিক রোমাঞ্চ লুকানোর সর্বাত্নক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। দলের নেতা হিসেবে মণি সিংহ বারবার সিপিবিকে শ্রমিকশ্রেণীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ দিয়েছেন। ইদানিংকালে তার অনুসারীরা এমন কথাও প্রচারে লিপ্ত হয়েছেন যে মণি সিংহ পার্টির ট্যাক্টিসের (রণকৌশল) সাথে একমত ছিলেন না (১)। একথার কোনো সত্যতা নেই, এমনকি তা প্রমাণের কোনো ঐতিহাসিক কিংবা পার্টি দলিলও নেই, এসব কথার একমাত্র বয়ানকারি তার জীবিত কমরেডরা, যাদের বর্তমান কর্মকান্ড আসলে আগের আমলের সুদিনের তুলনায় একচুলও বদলায়নি।সদ্য-স্বাধীন দেশগুলোর প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতির সাথে তাল মিলিয়ে সিপিবি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় । তখনকার বছরগুলোতে বামপন্থী বিশেষত চীনপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে (মাওবাদী পার্টিগুলো সহ) নির্মূল ও দমনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অভিযান চালানো হয়।১৯৭৩ সালে সিপিবির ছাত্র সংগঠন (বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে এক শক্তিশালী সমাবেশের আয়োজন করে। মার্কিন অসন্তোষের আশংকায় শেখ মুজিব কঠোরহস্তে পরিস্থিতি দমনের হুকুম দিলে পুলিশের গুলিতে দুজন ছাত্র (মতিউল ইসলাম , মির্জা কাদেরুল) শহীদ হয়। এরই প্রতিক্রিয়ায় জনগন ঢাকার রাস্তায় প্রচন্ড আক্রোশ ও ক্রোধে ফেটে পড়ে। কিছু বাম ছাত্র সংগঠন হরতালের আহবান জানায়। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও ঠিক পরের দিনই সিপিবি নেতারা শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে এবং টাল-মাটাল ক্রোধ উন্মত্ত আন্দোলনরত পরিস্থিতির জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে, আর এভাবেই আন্দোলনের লাগাম টেনে ধরে।"জাতির পিতা" স্বীয় তত্ত্বাবধানে "শুদ্ধি অভিযান" পরিচালনা করেছিলো, এবং এর দায়ভার কেবল মুজিবের নিজেরই নয়, সিপিবি যেহেতু জাতির পিতার এই ন্যায়পরায়ণ কুকর্ম নিয়ে মুখ খোলেনি, চোখে পট্টি বেঁধে বসে ছিল, এর দায়ভার সিপিবির উপরেও বর্তায়। ১৯৭৫ সালে সিপিবি বাকশালে অংশ নেয়। মুজিব এর নেতৃত্বে পূর্ববাঙলার সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। এই হত্যাকাণ্ডের পর মুজিবের হামবীর ধরনের বক্তব্যগুলোকে সিপিবি প্রশংসা করতে গিয়ে অনেকটা তামাশাকর পরিস্থিতিতে পতিত হয়। সিরাজ সিকদার ৩০ বছর বয়সে পুলিশ হেফাজত থেকে "পালিয়ে যাবার" অভিযোগে পুলিশের গুলিতে নিহত হন (২)। ১৯৭১ সনে যেখানে চীন-কর্তৃক পাকিস্তানের পক্ষ নেবার পর অন্যান্য চীন-পন্থি পার্টিগুলো কার্যত অকেজো হয়ে পড়েছিল, পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল; সেখানে সিরাজ সিকদার তার পার্টির নেতৃত্ব দেন ও ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন। শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ এবং সিপিবি নেতারাই ভারতের সোনাগাছিতে শুয়েবসে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন।মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন সিপিবি শেখ মুজিবের বাকশাল সরকারে যোগদান করে "সমাজতন্ত্র নির্মাণের এক নতুন পথে” যাত্রা শুরু করে(৩)। বাকশাল (বাঙলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ) ছিলো আওয়ামীলীগ(৪), ন্যাপ (মোজাফফর)(৫) এবং সিপিবি নিয়ে গঠিত এক পচা-গলা ঐক্যজোটের সরকার। অন্যান্য পার্টিগুলোকে মাইনাস করে দিয়ে, হাজার হাজার বামপন্থী কর্মীদের জেলে পাঠিয়ে নিষিদ্ধ করে, একটি অবান্তর বেপরোয়া এক্সপেরিমেন্টের দিকে ঠেলে দেয়া হয় বামপন্থী আন্দোলনকে। এটি ক্রেমলিনের প্রেস্ক্রিপশনে ঘটেছিল। একই প্রেস্ক্রিপশনে চিলিসহ অন্য কিছু দেশেও এমন ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের ব্যর্থ পথ কিছুটা গতি পেলেও, এটি মূলত স্বল্পস্থায়ী বাকশালকে কার্যকর করেছিলো, যা আদতে ছিল পেটি-বুর্জোয়া একনায়কত্ব। দিনশেষে এই মতাদর্শের অকার্যকরিতা খুব দ্রুতই প্রমাণিত হয়েছিল। মাত্র কয়েক মাসেই সেনাবাহিনী এই “তৃতীয়পন্থীদের” উচ্ছেদ করে (বাম-ডান মিলিয়ে গঠিত বাকশালকে তৃতীয়পন্থী বলা হয়েছে)।সিপিবি পরবর্তীকালে সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমানকেও (৬) সমর্থন করেছিল, এমনকি জেনারেল জিয়াউর রহমানের “হ্যা/না ভোট” এর পাব্লিক রেফারেন্ডামে সাপোর্ট করে এবং জিয়ার শাসনামলের শুরুর দিকের "একশন প্রোগ্রাম" যেমন খাল-খনন কর্মসূচিতে সহমত প্রদর্শন করে। একনায়ক জিয়াউর রহমানের ব্যাকআপে মণি সিংহ সবার সামনে বক্তব্যে বলেন তৃতীয় বিশ্বে সেনাবাহিনী কিছুটা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে(৭)। এইধরনের চাটুকারপন্থী বক্তব্য সত্ত্বেও জিয়া সিপিবির মণি সিংহসহ নেতৃস্থানীয় নেতাদের জেলে পাঠানো থেকে বিরত থাকেননি, এটাই সম্ভবত জিয়ার একমাত্র প্রগতিশীল ভূমিকা, তবে সেটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশগুলোর একটির (সেনাবাহিনী) সাথে এমন আপত্তিহীন রাজনৈতিক দহরম-মহরম ছাড়াও, সিপিবি তার মার্ক্সবাদ অনুশীলন থেকে এতটাই দূরে সরে গিয়েছিলো যে, তারা সেনাবাহিনীর মতো বুর্জোয়া রাষ্ট্রের একটি দমনমূলক যন্ত্রকে জনগনের পক্ষে কাজ করার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছিলো। সিপিবি সম্ভবত ওয়াকিবহাল ছিলো না যে, তৎকালীন চিলিতে এবং তার কিছুকাল আগে ইন্দোনেশিয়াতে কি ঘটেছিলো।বর্তমান সিপিবি হঠাৎ করে খুব সূক্ষ্ণভাবে এই ইতিহাসের এক নতুন বয়ান শুরু করেছে। তারা বলছে, মণি সিংহ নাকি এইসব ভুল সিদ্ধান্ত সমূহের সাথে কখনোই একমত ছিলেন না। তারা দাবি করেন, তিনি সিপিবিকে মুজিবের ক্ষমতাসীন জোটে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং জিয়াউর রহমানের সাথে সহযোগিতা করছিলেন পার্টি শৃংখলা বজায় রাখতে, পার্টি বিলীন করতে নয়। এসবের মূল উদ্দেশ্য হলো সিপিবির বারংবার বেঈমানীকে গোপন করা, প্রথমত সাবেক এই মহান নেতার দায়িত্ব এবং তার অভিপ্রায় এর পাপমোচনের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্রে তার স্মরণে লেখালেখি প্রচারের মাধ্যমে।দলীয় শৃঙ্খলার রক্ষার নামে আদর্শকে কোরবানি দিয়ে মাথা নত করা কী ধরনের বিপ্লবী নীতি? তিনি কী ধরনের নেতা যে বিপ্লবী অবস্থানকে আকড়ে ধরলেন না, এমনকি এতে যদি তিনি দলে সংখ্যালঘু হয়ে যেতেন তারপরেও? যখন জার্মান পার্লামেন্টের দুই-একজন ব্যাতিরেকে পার্টির প্রায় সকলেই নিজ দেশের বুর্জোয়াশ্রেণীর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধের জন্যে ভোট দেয়, তখন রোজা লুক্সেমবার্গ এবং কার্ল লিবনিখট আন্তর্জাতিকতাবাদী অবস্থান গ্রহণ করে যুদ্ধের বিপক্ষে ভোট দেন। ফলত, দলে ভাঙন দেখা দিলেও তা ছিলো আদর্শগত বিভাজন, এই দলই রাশিয়াতে বলশেভিক বিপ্লবের পর জার্মানিতে অন্যতম প্রভাবশালী দল হয়ে উঠে।১৯১৭ সালে লেনিন রাশিয়া ফিরে এপ্রিল-থিসিস প্রস্তাব করলে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। নতুন যেই চিন্তা ধারা তিনি উত্থাপন করেন তা বিপ্লবের দুইটি স্তরের দীর্ঘমেয়াদী ধারনাকে প্রত্যাখান করে, যার অর্থ বুর্জোয়া সরকারকে সহযোগিতা না করা এবং শ্রমিকশ্রেনীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের আহ্বান জানানো -যা কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। লেনিন কৌশলগতভাবে শ্রমজীবি জনতার কাছে তার রাজনৈতিক সিদ্বান্তকে (এপ্রিল থিসিস) সমর্থন দেয়ার আবেদন জানান, সমর্থন না করলে বলশেভিক পার্টি পৌরাণিক জাদুঘরে নিক্ষিপ্ত হবে দাবী করেন। ১৯১৮ সালে জার্মানির সাথে ব্রেস্ত-লিতভস্ক শান্তিচুক্তির (৩মার্চ, ১৯১৮তে বর্তমান বেলারুশে বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তি সমূহের সাথে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি যার ফলে রাশিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করে) ক্ষেত্রেও লেনিন পুনরায় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। প্রথম দফায় লেনিন নিজ মতাদর্শকে দৃঢ়চিত্তে সমর্থন করার মাধ্যমে বিপ্লবকে সফল করেন, আর দ্বিতীয় দফায় একইভাবে সোভিয়েত রাষ্ট্রকে রক্ষা করেন।বিপ্লবীদের উচিত পার্টির গনতান্ত্রিক অনুশীলনকে ব্যবহার করে শ্রেনী অবস্থানকে রক্ষা করা। যদি পার্টির মধ্যে গনতন্ত্র থাকতো তাহলে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের মাথায় পার্টি বিলুপ্তির সিদ্বান্ত আসতো না। দুনিয়ায় “জাতীয় গনতান্ত্রিক বিপ্লব” অথবা “জনগনতান্ত্রিক বিপ্লব” করার নামে শুধুমাত্র সিপিবি একাই মালিক শ্রেনীর সাথে সহযোগিতার পথে গিয়েছে তা নয়, এই কৌশল অনুসরণ জনগনের জন্যে ধ্বংস ছাড়া কিছু আনেনি। ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে বাঙলাদেশ পর্যন্ত, যেখানেই বামপন্থীরা বুর্জোয়াদের সাথে মৈত্রী করে "দ্বিস্তর নীতি" মেনে আন্দোলনের চেষ্টা করেছে, সেখানে আন্দোলন (প্রথম স্তরে অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশসমুহে জাতীয় পুঁজির বিকাশের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় বিপ্লব, দ্বিতীয় স্তরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব) প্রথম স্তরের পরেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। যেসকল দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ দেরিতে হয়েছে বিশেষ করে আধা-উপনিবেশিক দেশগুলো, সেখানে বুর্জোয়াদের কোনো প্রগতিশীল ভূমিকা নেই। গনতন্ত্র এবং জাতীয় মুক্তি তখনই সম্ভব যখন শ্রমিকশ্রেনী বুর্জোয়াশ্রেনী থেকে স্বাধীনভাবে নিজ শক্তির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবে। ১৯২০ এর শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টির মধ্যেই টু স্টেজ (দ্বিস্তর) বিপ্লবের ত্বত্ত্ব (two-stage revolution) নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। কিছু “পুরাতন বলশেভিক” “টু স্টেজ ত্বত্ত্ব” কে সমর্থন দেয়, অন্যদিকে অক্টোবর বিপ্লবের আগেই লেনিন এই তত্ত্ব পরিত্যাগ করেন। ১৯২০ সালে চীনকে কমিনটার্ন (Comintern-Communist International) এই পথে বিপ্লবের পরামর্শ দেয়, ফলাফল স্বরুপ মালিকশ্রেনী হাজারখানেক কমিউনিস্ট এবং শ্রমিক হত্যা করে। ইন্দোনেশিয়াতেও এমন ঘটনার পুনাবৃত্তি ঘটে। (ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি (PKI)১৯৬৫-১৯৬৬ সালে জাতীয়তাবাদী নেতা সুকার্নোর সাথে হাত মেলায় । তাদেরকে পরবর্তীতে জেনারেল সুহার্তো সামরিক ক্যু এর মাধ্যমে উৎখাত করে। কমিউনিস্ট পার্টি সহ শ্রমিক ইউনিয়ন নারী সংগঠন সব নিষিদ্ধ করে । প্রায় ১০ লক্ষ কমিউনিস্ট কর্মী এবং সমর্থককে হত্যা করে)মণি সিংহের পরিবার বাস করতেন সুসং নদীর তীরে, যার উৎপত্তি গারো পাহাড় থেকে। জমিদার পরিবারে সোনার চামচ-মুখে জন্ম নিলেও যৌবনের একেবারে শুরু থেকেই তিনি রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেন, যার প্রতিফলন তিনি দেখান হিন্দু জাতপ্রথার মত সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। উপনিবেশিক যুগের শাসনের শৃঙখল হোক কিংবা বিশ্বায়নের যুগের শোষণের নতুন শেকল হোক, তা ভাঙতে মণি সিংহের দৃঢ়চেতা মনোভাব আমাদের কাছে এক অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর বিশাল সংখ্যক কমিউনিস্ট পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ববঙগ-বর্তমান বাঙলাদেশ) ছেড়ে চলে গেলে এখানে বামপন্থী আন্দোলনে বিশাল শূন্যতা দেখা দেয়। তবে, মণি সিংহ এবং আরো অনেকেই সাহস করে এখানে রয়ে গেলেন লাল পতাকার সংগ্রাম এগিয়ে নেবার জন্যে। সম্ভবত এই কাজগুলো তার মহান কাজ যার জন্যে মণি সিংহকে সাধুবাদ দেয়া যায়।মণি সিংহ যখন সিপিআই তে (CPI- ইন্ডিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি) সক্রিয় ছিলেন তখন ছিলো বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লবের কাল। সেই সময়ে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে শ্রমিকশ্রেণীর গনতন্ত্র, পার্টিতে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, বৈশ্বিক বিপ্লব, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আশু কর্মসূচি নিয়ে বির্তক চলছিলো। একদিকে ট্রটস্কিসহ লেনিনবাদী বলশেভিকরা ছিলেন যারা বিপ্লবের লাল পতাকাকে ধারণ করছিলেন, অন্যদিকে ছিলো স্ট্যালিন ও তার আমলাতান্ত্রিক গং। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি এবং বৈশ্বিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে বির্তক হাজির হয়েছিলো তা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে মৌলিক প্রশ্ন হিসেবে স্থান পায়নি। তাও যে নিয়ন্ত্রিত বিতর্ক পার্টিতে হয়েছিলো, তা পার্টির গ্রাসরুটে পৌছানোর আগে দমিয়ে দেয়া হয় স্ট্যালিন পক্ষের চক্রান্তে। এম এন রায় (৮) স্ট্যালিনবাদী নেতৃত্বের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং বলশেভিক-লেনিনবাদকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেন। মণি সিংহ এই স্ট্যালিনবাদকেই গ্রহণ করেছিলেন। আর এভাবেই সম্ভাবনাময় একজন মহৎ বিপ্লবী বিপথগামী হয়ে পড়ে।মণি সিংহের স্ট্যালিনবাদী রাজনীতি- তথা শ্রেনীসমন্বয়ের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি কখনোই এই চিন্তাধারা থেকে ত্যাগ করতে সফল হননি। মণি সিংহ এবং সিপিআইয়ে (CPI- ইন্ডিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি) তার সহযোদ্ধারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বৃত্তি করেন, যা ছিলো বিশ্বব্যাপী স্ট্যালিনবাদী পার্টিগুলোর তুলনামূলক “গনতান্ত্রিক” সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে সহযোগিতার নামে নিজ দেশের শাসকশ্রেনীর দালালী করার নীতির প্রতিফলন। যা ছিলো রোজা, লেনিন, ট্রটস্কি , লিবনিখট এবং অন্য বিপ্লবীদের চিন্তাধারার সাথে সাংঘর্ষিক; প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তারা স্লোগান দিয়েছিলেন “নিজ দেশের শাসকশ্রেনীই তোমাদের আসল শত্রু”, “বন্দুকের নলটা তাই নিজ দেশের বুর্জোয়াদের মাথায় ধরতে হবে” এবং “সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের জন্যে এক পয়সাও না, কোনো ব্যক্তির এক ফোটা রক্তও দেয়া হবে না”। সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া) ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারতে বিভাজনকে সাপোর্ট করেছিলো। আর পরে (৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর) মণি সিংহ নেতৃত্বাধীন সিপিবি মুজিবের “সমাজতান্ত্রিক” মোড়কের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা এবং জিয়ার “তথাকথিত প্রগতিশীল” চিন্তাদর্শে প্রলুব্ধ হয়ে পড়লো।মণি সিংহ গারো এবং হাজংদের(৯) উপর জাতিগত শোষনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটান। তিনি এইসকল সংখ্যালঘু আদিবাসী, যারা শতবছর ধরে জমিদার শ্রেনী দ্বারা নিপীড়িত ছিলেন, তাদের দ্বারা সংগঠিত প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা করেন। পারিবারিক হুমকি-ধামকি এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে এসব আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে একজন দৃঢ়চেতা এবং সংকল্পবদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন মণি সিংহ। অন্যদিকে বর্তমান(২০০০ এর প্রথম দশক) বামপন্থীরা সংখ্যালঘু আদিবাসীদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে খুবই লজ্জাজনক ভূমিকা পালন করছে। বাম গনতান্ত্রিক জোট (১০) (Left Democratic Front), সিপিবি যার অন্তর্ভুক্ত, তারা আজ বাঙালি জাতীয়বাদের(১১) ধোয়া তুলছে এবং এর প্রশংসা করছে। বাঙলাদেশে আদিবাসীরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। স্বাধীনতার পর থেকে পাহাড়ি জনপদের আদিবাসীরা সেনাবাহিনীর নজরদারিতে জীবন পার করছে। বাম গনতান্ত্রিক জোটের(LDF-Left Democratic Front) আন্দোলন যতটা জোরদার হবার কথা ছিলো ততটা হয়নি। যখন একটি দল বা জোট একটি সুনির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদ অনুশীলন কিম্বা লালন করে, তখন অন্য জাতিসমূহের অধিকার চাপা পড়ে যায়। যেকোনো বিপ্লবী পার্টির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং সুগভীর রাজনৈতিক ইস্যুতে সিদ্বান্ত ও পক্ষ নিতে হবে শ্রেনী ভিত্তিতে, জাতিগত ভিত্তিতে নয়। এমনকি সবচেয়ে “খাঁটি”, “ন্যায্য”, কিম্বা “পরিশোধিত”, “সভ্য” ধরনের জাতীয়তাবাদ হলেও তার সাথে মার্ক্সবাদকে গুলিয়ে ফেলার প্রশ্নই আসে না। সকল ধরনের জাতীয়বাদের বিপরীতে মার্ক্সবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদকে উর্ধ্বে তুলে ধরে।বাঙলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর, মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন সিপিবিতে ডানপন্থী ঝোঁক দেখা দেয়। দলটি আওয়ামীলীগের নীতি এবং কর্মকান্ডসহ, সহস্র বামপন্থী নেতা-কর্মী হত্যা ও কারাবন্দী করার মতো অন্যায়ের নীতিগত সমর্থক হয়ে উঠে। ১৯৭৫ সালে বাকশালে যোগ দেবার জন্যে সিপিবি বিলুপ্ত করে দেয়া হয় এবং পরে দলটি জিয়াউর রহমানের কর্মসূচির সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করেছিলো। ১৯৮০ সালে সামরিক শাসনের অধীনে দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বৈধতা দিতে নতুন থিসিস রচিত হয়। এমনকি ৮০’র নির্বাচনের অংশগ্রহণ করতে গিয়ে পোস্টারে এবং ব্যালটে তারা নিজেদের হাতুরি-কাস্তে প্রতীকের পরিবর্তে আওয়ামীলীগের প্রতীক ব্যবহার করে। সিপিবি প্রার্থীদের বুর্জোয়া ক্যাম্পে বিলীন হয়ে মিলিয়ে যাবার ব্যাপারটি মূলত মার্ক্সবাদী শিক্ষার একটি সচিত্র উদাহরণ। মার্ক্সবাদ আমাদেরকে শেখায়, যেসব কমিউনিস্টরা পরিস্থিতির সুবিধা নিতে নিজেদের পরিচয়কে অস্বীকার করতে পারে, তারা শ্রেণি সংগ্রামে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনা।মণি সিংহের রাজনৈতিক অবদান মূল্যায়ন করতে গেলে, পার্টির ইতিহাসের এসকল ঘটনার দিকেও আলোকপাত করতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার কর্মকান্ডকে উপেক্ষা করে, তার ব্যক্তিগত আত্নত্যাগকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে মহান বামপন্থী সংগ্রামী নায়কের খাতায় তার নাম লেখানো ভুল কাজ। মণি সিংহের ব্যক্তিজীবন কারো কাছে অনুসরনীয় হতেই পারে, কিন্তু সে যেভাবে স্ট্যলিনবাদী শ্রেণিসমন্বয়ের রাজনীতি করেছেন তা অনুকরণ করলে পরিণামে বিপদ আছে। তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতিকে মারাত্তকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্ত আন্দোলনের সেই ক্ষতি এখনো পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। মণি সিংহের রাজনীতির সত্যিকার যাচাইকরণ বাম রাজনীতির জন্যেই সুফল বয়ে আনবে।১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিপিবি নেতা-কর্মী আওয়ামীলিগে যোগদান করেন। অবশিষ্টরা ডক্টর কামাল হোসেনের সাথে মিলে নতুন দল গঠনের পায়তারা করে। ৭২-৭৫ সনে আওয়ামীলীগ যে ঘৃন্য হত্যাকান্ডসমূহ চালিয়েছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে, সেই হত্যাকান্ডসমূহের একজন অন্যতম স্থপতি ছিলেন এই ডক্টর কামাল হোসেন। মূলত কামাল হোসেনের মন্ত্রীত্বকালীন সময়েই বিশেষ ক্ষমতা আইন (১৯৭৪) এর মত নিপীড়নমূলক আইন পাশ করা হয়েছিল। বর্তমানকালে কামাল হোসেন একজন “গণতান্ত্রিক” ধ্বজাধারী হয়ে উঠেছেন, বাম ঘরানার রাজনীতিকরা তার দিকে ঝুঁকেছে পপুলার ফ্রন্ট (১১) পার্টি এলায়েন্স এর মাধ্যমে। বাকি সিপিবির একটি অংশ বিপ্লবী প্রপাগান্ডা ছড়ানোতেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু পার্টির কাজকর্ম সবসময় ক্ষমতাশালী দলের সাথে আপোষ করাতেই সীমাবদ্ধ। গত পাঁচ বছরে(১৯৯৬-২০০১) সিপিবিসহ প্রধান বামদল গুলো অনেকবার শেখ হাসিনার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করেছে। সিপিবি আওয়ামীলীগের সাথে সুর মিলিয়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের হত্যাকারী সেনা অফিসারদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে আসছে। সিপিবি মুজিবের হত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড চায়। শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড দাবী করার মাধ্যমে সিপিবি আসলে কি চায়? তারা কি বিদ্যমান বুর্জোয়া বিচার ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে চায়? বিপ্লবী মার্ক্সবাদীরা শুধুমাত্র মুজিবের খুনিদের বিচার চায় না, যারা সিরাজ সিকদার, মনিরুজ্জামান তারা(১২), আবু তাহের(১৩) এবং অন্যান্য বামপন্থী নেতাদের হত্যা করলো, তাদেরও বিচার চায়। এমনকি তাদের জেলবন্দী ও হত্যার সকল ডকুমেন্টস প্রকাশ করা হবে জনসম্মুখে এই বিচারের প্রক্রিয়া হিসেবে। বিপ্লবী মার্ক্সবাদীরা বুর্জোয়া বিচার ব্যবস্থার তথাকথিত “সুবিচারের” উপর আস্থা রাখে না। পুলিশ , সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র , বিচারব্যাবস্থা নিপীড়ক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের খুটিঃ তাই বুর্জোয়ারা তাদের এই প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিচারের সম্মুখীন করবে না। শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেনী ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কৃত সকল অপরাধের নথি-পত্র ফাস করার মাধ্যমে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাই সিপিবি যে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার স্লোগান দেয় তা আসলে শাসক দলের (আওয়ামীলীগ) সাথে তাদের সম্পর্ককে সুসংহত করে। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা মণি সিংহের জন্মশতবার্ষিকীর স্মরণসভায় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন এবং এই কারণে তার মন্ত্রীসভার নেতা মতিয়া চৌধুরি অন্য আরেক স্মরনসভায় প্রধানবক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হন ।সিপিবিসহ অন্য স্ট্যালিনবাদী দলগুলো নিজেদের লাল-পতাকার সুদৃঢ় উত্তরাধিকারী দাবি করে। স্ট্যালিনবাদী দলগুলোর জন্যে বিপ্লবী ঐতিহ্য ধারণ করা অসম্ভবঃ কথায় ও কাজে তারা সংশোধনবাদী যারা এখনো বুর্জোয়া প্রগতিশীল ভূমিকায় আস্থা রাখে। মণি সিংহের জন্মশতবার্ষিকীর সভায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি আসলে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা স্ট্যালিনবাদের ঐতিহাসিক দেউলিয়াত্বের প্রতিফলন। লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াদের সাথে সহযোগিতা করে এক “পুণ্যকর্ম” সাধন করেন।ট্রটস্কির বিরোধিতা করে স্ট্যালিন তার মিত্র চিয়াং কাই শেককে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যশনালের সম্মানিত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। স্ট্যালিনের বন্ধু এই “সম্মানিত” সদস্যের আদেশেই ১৯২৭ সালে সাংহাই কমিউনে ম্যাসাকার (চীনের সাংহাইয়ে তৎকালীন ডানপন্থী দল কুমিংতাং পার্টির নেতা চিয়াং কাই শেক সিসিপি, সমমনা বামপন্থী ও শ্রমিক ইউনিয়নের উপর গণহত্যা চালায় এতে ৫,০০০-১০,০০০ নেতা-কর্মী নিহত হয়) সংগঠিত হয়। কমিনটার্ন এর পলিসি অনুসরণ করে ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে পপুলার ফ্রন্ট গঠন করার ফলে ১৯৩৬ সালে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের সুযোগ হাতছাড়া করে। জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টি সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের সাথে হিটলার বিরোধি ইউনাইটেড ফ্রন্টে যোগ না দেয়ার এক ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্ট্যালিন "গনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদীদের" বন্ধু হয়ে গেলে, বিশ্বব্যাপী স্ট্যালিনবাদী দল গুলো নিজ নিজ শাসকশ্রেনীকে সহায়তা করে। ইন্ডিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের উপনিবেশিক প্রভুকে সহায়তায় করায় পুরস্কৃত করা হয়। স্ট্যালিনবাদী পার্টির সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের অবশ্যই তাদের স্ট্যালিনবাদী শ্রেনী সমন্বয়কারী নেতৃত্বেকে রুখে দিতে হবে! লেনিন ও ট্রটস্কির বিপ্লবী ঐতিহ্যের পক্ষে দাড়াতে হবে! লেনিনবাদী পার্টি গঠন করতে হবে!গনতান্ত্রিক মজদুর পার্টি (জিপিও নম্বর -২৪৭৩)ঢাকা-১০০০, বাঙলাদেশফুটনোটস-১) দৈনিক জনকন্ঠ, ২৮শ জুলাই, ২০০১ । সন্তোষ গুপ্ত লিখিত একটি আর্টিকেল । যিনি একজন সাবেক সিপিবি নেতা এবং সাবেক সেনা একনায়ক জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করা মনি সিংহ ও সিপিবি ডেলিগেটসদের একজন। (“সংশপ্তক” নামক আর্টিকেলটি বর্তমানে পাওয়া যাবে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে বের হওয়া “মনি সিংহ স্বারকগ্রন্থে” )২) পূর্ব বাঙলার সর্বহারা পার্টি(পূবাসপা) ১৯৬৯ সালে গঠিত হয় যা ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৭৫ সালে সিরাজ সিকদারের বিচার বহির্ভূত হত্যার পর পার্টি প্রথমে দুইভাগে ভাগ হয়। এরপর এই দুই ভাগ আরো নানান উপদলে বিভক্ত হয়। এখনো একটি অংশ আন্ডারগ্রাউন্ডে কার্যকর আছে, একটি অংশ এনভার হোক্সা (আলবেনিয়ান পার্টি অব লেবারের নেতা আনোয়ার হোজ্জা) লাইন অনুসরণ করে, অন্যান্য উপদল গুলো মাও’য়ের দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের নানান লাইনকে ধারণ করে। এদেরই একটি অংশ লন্ডন ভিত্তিক মাওবাদী আন্তর্জাতিক রেভোলিউশনারী ইন্ট্যারন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (RIM) এর অন্তর্ভুক্ত। পূর্ব বাঙলার সর্বহারা পার্টির (পূবাসপা) আন্তদলীয় সংগ্রামের (inner party struggle) নামে নিজ পার্টি কমরেডদের হত্যার জঘন্য ইতিহাস রয়েছে।৩) বাকশাল(বাঙলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ)-১৯৭৫ সালে আওয়ামীলীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফফর) এবং সিপিবি নিয়ে গঠিত শাসক-শ্রেনীরই একটি রাজনৈতিক জোট। বাকশাল সরকার নিজেদের পলিসিকে “সমাজতন্ত্র” নির্মাণের একটি পথ হিসেবে দাবী করে এবং অন্য সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেয়। এ সরকার চারটি সংবাদপত্র ছাড়া বাদবাকি সব পত্রিকা নিষিদ্ধ করে।৪) বাঙলাদেশ আওয়ামীলীগ হলো বাঙলাদেশের বড় বুর্জোয়া দলগুলোর একটি, যারা ভারতীয় দোসরদের সাহায্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়। লীগ ১৯৭২-১৯৭৫ সাল , ১৯৯৬-২০০০, ২০০৯-২০১৪ সর্বশেষ ২০১৪ সালের লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের সংসদীয় গনতন্ত্র কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে ২০২৪ সালের জুলাই ( একটানা ১৬ বছর) পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলো। ছাত্র জনতার জুলাই অভ্যুথানে খুনি হাসিনা লেজ গুটিয়ে তার নানাবাড়ি ভারতে আশ্রয় নেয়।৫) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-NAP) ১৯৫৭ সালে মার্কিন বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আওয়ামীলীগ থেকে বের হয়ে গঠিত হয়। ১৯৬৫ সালে মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বে এই দল দুই ভাগে ভাগ হয়। যার একটি ন্যাপ (ভাসানী) বিভিন্ন চীন-পন্থী রাজনৈতিক দলের ও নেতা কর্মীদের আশ্রয়স্থল, অপর অংশটি ন্যাপ (মোজাফফর) ছিলো সিপিবি ও মস্কো-পন্থি দল ও নেতা কর্মীদের আশ্রয়স্থল।৬) জিয়াউর রহমান, একজন সেনাবাহিনীর একনায়ক যিনি ১৯৭৫-১৯৮১ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। পরে এক ব্যর্থ অভ্যুথানে তাকে হত্যা করা হয়। বাঙলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তার দল ১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬ সালে নির্বাচিত হয়েছিলো।৭) দৈনিক জনকন্ঠ, ২৮ জুলাই,২০০১ । সন্তোষ গুপ্ত কর্তৃক লিখিত একটি প্রবন্ধ।৮)এম এন রায়- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন, স্ট্যালিনের সমর্থক ছিলেন পরে র্যাডিকাল মানবতাবাদ মতাদর্শ প্রচার করেন।৯)গারো হাজং - সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায় যারা একদা আসাম ও ভারতের গারো পাহাড়ের পাদদেশে বাস করতো। পরবর্তীতে বাঙলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে তারা এসে বসতি স্থাপন করে। বাঙলাদেশের আরো ১৫টি জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসীদের মতো তারো সরকারী স্বীকৃতি পায়নি১০)বাম গনতান্ত্রিক ফ্রন্ট- ১০ টি স্ট্যালিনবাদি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত পপুলার ফ্রন্ট১১)বাম গনতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঘোষণাপত্র পৃষ্ঠা-১, ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত১২)মনিরুজ্জামান তারা- পূর্ব বাঙলা কমিউনিস্ট পার্টির (এম-এল) (পূবাকপা) সাধারণ সম্পাদক, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য অঞ্চলে নকশাল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে দলটি গঠিত হয়। ১৯৭৫’র শুরুর দিকে ঢাকা থেকে মনিরুজ্জামান তারাকে গ্রেফতার করা হয় এবং জেলে প্রেরণ করার পর ২২শে মে, ১৯৭৫ সালে সিরাজগঞ্জের কবরস্থানে তার মৃত দেহ পাওয়া যায়।১৩) কর্ণেল আবু তাহের - একজন অবসর প্রাপ্ত আর্মি অফিসার যিনি ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। তিনি গণবাহিনী(পিপলস আর্মি) গঠনের চিন্তা তুলে ধরেন। কিন্তু শেখ মুজিব এবং এলিট অফিসাররা তার চিন্তাকে প্রত্যাখান করে। তিনি আওয়ামীলীগ ভেঙ্গে গড়ে উঠা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে(জাসদ) যোগ দেন। তারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যে দলে কর্মী সংখ্যা বাড়াতে থাকে। ৭ নভেম্বর,১৯৭৫ দলটি সিপাহী-জনতার অভ্যুথান করে এবং জিয়ার হাতে ক্ষমতা দেয়া হয়। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর শৃঙখলা ভঙ্গের অজুহাতে ১৯৭৬ সালে তাহেরকে ফাসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেন।