১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অসম্পূর্ণ বিপ্লব

বাংলাদেশের বিপ্লব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল পৃথিবী কাঁপানো ঘটনা। কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল, তা খুব কম মানুষই জানেন।

[Translated by Talha Mahmood Chowdhury]

আজ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে মিথ্যার চাদরে ঢেকে দিয়েছে। তারা নিজেদের গৌরবান্বিত করতে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের দলের ভূমিকা বাড়িয়ে বলার মধ্যেই ব্যতিব্যস্ত।

কিন্তু সেই ইতিহাসের আসল নায়ক ছিলেন নাম না জানা লাখ লাখ বাংলাদেশি মানুষ, যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলো এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলো। প্রায় দেড় দশকের স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ও উৎখাতের মধ্য দিয়ে আরও একবার বিপ্লবের জোয়ারে ভেসেছিল বাঙালি জাতি (মতান্ত্বরে বাংলাদেশী)। সাফল্য, ব্যর্থতা, মানুষের মুক্তি, এসব প্রশ্ন কেবলমাত্র ইতিহাসই উত্তর দিতে পারে। তবে এবারও নাম জানা এবং নাম না জানা হাজার হাজার মানুষের রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়েই বিপ্লবটি সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং, বাংলাদেশের ইতিহাসকে পুনরায় খতিয়ে দেখবার এখনই সঠিক সময়। এখনই সঠিক ইতিহাস জানানোর সময় এসেছে।

ভারত বিভাজন (১৯৪৭)

১৯৪৭ সালের ১৪ই ও ১৫ই আগস্ট মানবতার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। ভারত বিভাজনের সময় সাম্প্রদায়িক হিংসার জেড়ে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিলো, আনুমানিক ৭৫ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো এবং ১০ থেকে ২০ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছিলো। টেড গ্র্যান্ট এই অপরাধের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন:

"ভারত উপমহাদেশকে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুই ভাগে বিভক্ত করা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একটি অপরাধ। প্রথমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ পুরো উপমহাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে একটি বিপ্লবী পরিস্থিতি গর্জে উঠে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বুঝতে পেরেছিলো যে এই পরিস্থিতি আর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তখন তাদের সেনাবাহিনীতে মূলত ছিল ভারতীয় সৈন্য, যারা সাম্রাজ্যবাদীদের গোলামি করার জন্য আর নির্ভরযোগ্য ছিল না।

এমতাবস্থায় সাম্রাজ্যবাদীরা দেশভাগের ধারণা নিয়ে এলো। তারা যখন দেখল পরিস্থিতি আর হাতের মুঠোয় নেই, তখন তারা মুসলিমদেরকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে এবং হিন্দুদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়াটাই অধিকতর উপযুক্ত বলে গ্রহণ করলো। এই পদ্ধতিতে তারা উপমহাদেশকে ভাগ করে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ মনে করলো, যাতে সামরিক উপস্থিতি ছাড়াই বাইরে থেকে শাসন চালানো যায়। তারা এই কাজ করার সময় মাথায় রাখেনি যে এর ফলে রক্তপাত ও ধ্বংসের বিস্তার হতে পারে।" (টেড গ্র্যান্ট, ২০০১)

এ পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো। মাত্র এক বছর আগেই দখলদার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দু, শিখ এবং মুসলমানরা কাধে কাধ মিলিয়ে ব্যারিকেডের সামনে দাড়িয়েছিলো।

পরিস্থিতি ব্রিটিশরা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলো না বিধায় তাদেরকে “বিভাজন করো, শাসন করো” নীতির পথে হাটতে হয়। হিন্দু-মুসলিম অভিজাত-শাসকদের মাধ্যমে উপমহাদেশকে ধর্মীয় বিভাজনের এক মৃত্যুকূপে নিপতিত করা হলো।

ইন্ডিয়া হয়েছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দেশ আর নবগঠিত পাকিস্তান হয়েছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ।

বাংলা পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আবাসস্থল পশ্চিমবঙ্গ ইন্ডিয়ার অধীনে গেলো আর পূর্ববঙ্গ যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো মুসলিম, তা পূর্বপাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) নামে পাকিস্তানের অংশ হলো ।

পূর্ব পাকিস্তান

পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ একই ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তারা ভিন্ন ভাষায় কথা বলত, আর দু'অঞ্চলের মাঝে ১,২০০ মাইলের বিস্তর ভূখণ্ডের ফারাক!

শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের শিকার হচ্ছিল।

১৯৭০ সাল নাগাদ, পশ্চিম পাকিস্তানের মাত্র ২২টি পুঁজিপতি পরিবার পূর্ব পাকিস্তানের ৬৬% শিল্প ও ৮০% ব্যাংকিং সেক্টরের মালিক ছিল। জনসংখ্যার বেশিরভাগ পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও রাজধানী করা ছিলো করাচিতে।

অধিকন্তু, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে শ্রমিকদের গড় মাসিক মজুরি ছিল তৎকালীন ৩৫ পাউন্ড (বর্তমান হিসাবে ৫৫০০ টাকা/ তৎকালীন হিসেবে ৯১.৫ টাকা), পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মাত্র ১৫ পাউন্ড (বর্তমান হিসাবে ২৪০০ ততকালীন হিসেবে ৬৫ টাকা)। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিমপাকিস্তানের পণ্য সামগ্রীর একচেটিয়া বাজার, যেখানে সম্পদ অনবরত পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হত।

সেনাবাহিনীর ৯০% ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি, আর উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানিদের হার ছিল মাত্র ১৬%। উর্দুকে জাতীয় ভাষা ঘোষণা করা হয়েছিল, যদিও বড়জোর ৭% মানুষ এ ভাষায় কথা বলত, সে তুলনায় ৫৫% মানুষের ভাষা ছিল বাংলা ।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের বিশেষ সুবিধা ও সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করতে বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল ।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের একটি আধা-উপনিবেশে, যেখানে বাঙালিরা ছিল নির্যাতিত, নিষ্পেষিত।

লেনিন একবার বলেছিলেন, জাতীয় প্রশ্ন মূলত চূড়ান্তভাবে সম্পদ আর রুটিরুজিরই প্রশ্ন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের অপরিহার্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় ।

পাকিস্তানী রাষ্ট্রের ভিত্তি যেনো এক ডিনামাইটের উপর নির্মিত হলো।

ভাষা আন্দোলন

১৯৫২ সালে প্রথমবার বাংলা ভাষার স্বীকৃতি ও চর্চার দাবিতে একটি বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। পুলিশের গুলিতে বহু ছাত্র-কর্মী নিহত হওয়ার পর এই আন্দোলন গণসমর্থন লাভ করে।

এই আন্দোলনের সময় তরুণ মুজিবর রহমান (সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক খুনি হাসিনার পিতা) পরিচিতি লাভ করেন। তিনি পরবর্তীতে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ দল আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে উঠেন, যা স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।

মুজিব ছিলেন মধ্যবিত্ত, ভূসম্পত্তি-সম্পন্ন পরিবারের সন্তান এবং 'পশ্চিমা ধাঁচের' গণতন্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ক্যারিশম্যাটিক ও উচ্চশিক্ষিত – উদীয়মান বাঙালি পেটি-বুর্জোয়াদের জন্য একজন আদর্শ মুখপাত্র।

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী জোট যুক্তফ্রন্ট ৬৫.৫% ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষে ভীত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মাত্র ৫৬ দিনের মাথায় সরকার ভেঙে দেয় এবং ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৫০-এর দশকের ওই অশান্ত পর্বেই আধুনিক বাংলাদেশি জাতি-চেতনার বিকাশ হয়।

স্বৈরশাসনের যুগ

পাকিস্তানের 'গণতন্ত্র' ১৯৫৮ সালেই ধ্বংস হয়। রাজনৈতিক,সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার দরুণ রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিরোধী শ্রেণীসমূহের মধ্যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

১৯৫৮ সালে সেনা কর্মকর্তা আইয়ুব খান এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন এবং লৌহমানব হিসেবে শাসন শুরু করে "অরাজকতা থেকে দেশ বাঁচানোর" নামে শ্রেনীসমূহের মধ্যে তথাকথিত ব্যালেন্স নিয়ে আসেন। সামরিক আইন জারি করা হয় এবং সব রাজনৈতিক সমাবেশ নিষিদ্ধ হয়। বাঙালি সংস্কৃতিকে দমন করা হয়।

আইয়ুব খান আমেরিকান সেনাবাহিনীকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যাতে এ অঞ্চল পাকিস্তান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়।

এই সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানে দৃশ্যমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। ট্রেড ইউনিয়ন কার্যত অবৈধ ছিল বলে পাকিস্তান বিদেশি বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়।

শিল্পায়নের ফলে পাকিস্তানজুড়ে শহরগুলোতে এক শক্তিশালী শ্রমিক শ্রেণী উঠে আসে, যারা ধীরে ধীরে শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হতে থাকে। একদিকে সাধারণ মানুষ ভয়ংকর কর্মপরিবেশে জীবনযাপন করতে থাকে, অন্যদিকে পুঁজিপতি, জমিদার ও সামরিক অভিজাতরা তাদের ধন-সম্পদের জাঁকজমক দেখাতে ব্যস্ত থাকতো।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারতের সাথে কাশ্মীর নিয়ে এক ব্যয়বহুল ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে সে সময় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়।

প্রেস সেন্সরশিপ ও রাজনৈতিক মতপ্রকাশের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর জাতীয় নিপীড়নের অনুভূতি তীব্র করে তোলে।

এসব কিছুই শ্রেণী সংঘর্ষের এক বিশাল মহাবিস্ফোরণের ভিত্তি তৈরি করে। কেবল একটি স্ফূলিঙ্গের দরকার ছিল যা এই শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জমে থাকা ঘৃণা ও ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে অন্যায়কে ভাসিয়ে দেবে।

পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা বিপুল পরিমাণ জমির মালিকানা ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর শ্রম সস্তা দরে শোষণ করে অতিমুনাফা অর্জন করত।

ফলে, জমিদার ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে থাকা পাকিস্তানি বুর্জোয়া শ্রেণী তখন কৃষকদের ন্যায্য জমি দেওয়া ও নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীদের স্বাধীনতার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে তাদের সম্পূর্ণ অক্ষমতা প্রমাণিত হয়।

১৯৬৬ সালে মুজিবুর রহমান 'ছয় দফা কর্মসূচি' পেশ করেন যা পাকিস্তান ফেডারেশনের মধ্যে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন ও সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবি জানায়। এতে পৃথক সামরিক বাহিনী গঠনের অধিকার, নিজস্ব কর ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অধিকারসহ দুটি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থার দাবি করা হয়।

এই কর্মসূচি, যতই মধ্যপন্থী হোক না কেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান ছিল শাসকগোষ্ঠীর (যাদের বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত) মুনাফার প্রধান উৎস, আবার একইসাথে এর জনসংখ্যা ছিল সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সার্বজনীন ভোটাধিকার মেনে নিলে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারানোর শঙ্কা ছিল (যা পরবর্তীতে ঘটেছে)। পূর্ব পাকিস্তানকে কর ধার্য ও নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা দিলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারাতো।

উপরন্তু, এই ছয় দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন নিয়ে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল।

বিপ্লবের সূচনা

১৯৬৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে রেল কর্মীদের এক সশস্ত্র ধর্মঘট এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে (পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী) কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দল সমন্বিত 'যুক্তফ্রন্ট' সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের প্রাক্কাল শুরু হয়, যার সমর্থনে সহস্র মানুষ কলকাতার রাস্তায় নেমে আসে।

দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা সতর্ক করে লিখেছিল: "এশিয়ায় যদি কোথাও শহুরে বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে, তা হলো কলকাতা, আর পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলোও পিছিয়ে নেই।"

তারা ভুল বলেনি। ৭ নভেম্বর ১৯৬৮ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরত অবস্থায় এক ছাত্র নিহত হলে, পূর্ব-পাকিস্তানসহ সারা দেশে জমে থাকা ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

শাসনব্যাবস্থার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ঘৃণা উথলে উঠে।

তখন আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিলো মূলত আওয়ামী লীগের মুজিবুর রহমান এবং মাওবাদী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) যা ছিলো চীনপন্থি কৃষক সংগঠন এর প্রেসিডেন্ট 'রেড' মওলানা ভাসানীর হাতে।

মাওলানা ভাসানী ছিলেন মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি মাও ও চীন বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত, যিনি বিশ্বাস করতেন কৃষক নেতৃত্বে সশস্ত্র গেরিলা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব। ১৯৬৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সচেতন কৃষক নেতাদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।

তিনি কৃষক ও ছাত্র যুবাদের মধ্যে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

১৯৬৮ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে ভাসানী দরিদ্র কৃষকদেরকে দুর্নীতিবাজ উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বাসভবন ও তহসিল অফিস (জমি রাজস্ব ও মালিকানার দায়িত্বে থাকা অফিস) ঘেরাও করার আহ্বান জানান। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে একাধিক জেলায় এই 'ঘেরাও' আন্দোলন শুরু হয়।

৬ ডিসেম্বর ভাসানী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। সরকার দমন-পীড়ন ও সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এইবারে আন্দোলনের রক্ষার্থে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমর্থনে ১৩ ডিসেম্বর আরেকটি সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়।

এই আন্দোলনের সমান্তরালে চলতে থাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি, যেখানে মুজিবসহ ৩৪ জনকে ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত করার কথিত অভিযোগ এনে বিচার করা হচ্ছিলো। বিচারের চূড়ান্ত তারিখ এগিয়ে আসার সাথে সাথে আসামিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে।

৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্র গ্রুপগুলোর একত্রীকরণের মাধ্যমে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এটি বিপ্লবের অগ্রভাগে অবস্থান নেয় যার উপর ভর করে পরে যেন আরও বড় আন্দোলন সংঘটিত হতে পারে।

ছাত্রদের পেশকৃত '১১ দফা' কর্মসূচি মুজিবের '৬ দফা'কে ছাড়িয়ে যায়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, রাজবন্দীদের মুক্তি, সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, কৃষকদের উপর কর হ্রাস এবং "ব্যাংক, বীমা কোম্পানি ও পাটসহ সকল বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণ" এর দাবি উত্থাপিত হয়। নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আন্দোলন ক্রমশ র‍্যাডিকাল আকারে রূপ নিতে থাকে, গণতান্ত্রিক দাবিগুলোকে সামাজিক দাবির সাথে একত্রীত করে একটি পুঁজিবাদ বিরোধী চরিত্র অর্জন করে।

২০ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শহীদ হলে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তার আত্মত্যাগ আজও অবিস্মরণীয়। পরদিন ছাত্ররা হরতালের ডাক দেয় যা সার্বজনীনভাবে পালিত হয়।

প্রত্যেক প্রতিবাদকারী শহীদ হওয়ার সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষ আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে, যা দিন দিন আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে:

"বুর্জোয়া নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রাম জনগণের বিপ্লবী জোয়ারে রূপ নেয়। মেহনতি মানুষ যথাক্রমে রিকশাচালক, মোটরচালক ও অন্যান্য দিনমজুররা ছাত্রদের সাথে হাত মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মোকাবেলা করে। গণঅভ্যুত্থান শাসকগোষ্ঠীর স্থিতিশীলতার মুখোশ উন্মোচন করে এবং প্রশাসন ভেঙে পড়ে।" (কামরুদ্দিন আহমদ, লেবার মুভমেন্ট ইন বাংলাদেশ, ১৯৭৮)

১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা একটি মিছিলে সৈন্যের বেয়নেটের আঘাতে নিহত হন। খবর ঢাকায় পৌঁছামাত্র পরিস্থিতি বিস্ফোরক হয়ে ওঠে।

কর্তৃপক্ষ কারফিউ জারি করলে তা তৎক্ষণাৎ উপেক্ষা করা হয়। ছাত্র-শ্রমিকদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। গুলি তখন আর ভীতির কারণ থাকল না।

জনগণ যখন ভয় হারায়, তা যেকোনো শাসন ব্যাবস্থার মৃত্যুঘণ্টা বাজায়। আইয়ুব খানের দিন গোনা শুরু হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঘোষণা করেন যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি দাঁড়াবেন না, যা দেশের ইতিহাসে প্রথম সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করে কারফিউ প্রত্যাহার ও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি জানায়। ২২ ফেব্রুয়ারি মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয় যাকে উল্লসিত জনতা সংবর্ধনা জানায়।

কি দারুণ বিজয়! কিন্তু মুজিবের মুক্তি জনগণকে শান্ত করার বদলে বিপরীত প্রভাব ফেলে: তারা আরও সাহসী হয়ে ওঠে এবং মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায়!

এটি বিপ্লবের একটি টার্নিং পয়েন্ট। শহরের শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করে, গ্রামাঞ্চলে কৃষকরাও তাদের অনুসরণ করে।

মার্চ মাসে দ্য টাইমস লিখেছিল: "প্রায় প্রতিদিনই ডাক্তার থেকে রেলওয়ে কর্মী ও সরকারি প্রকৌশলীসহ সকল পেশা, কারবার ও জীবিকার ধর্মঘটীরা রাস্তায় মিছিল করে কাজের পরিবেশ ও বেতন বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছিলো... দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকার রাস্তায় পুলিশের ইউনিফর্ম দেখা যায়নি।"

বিপ্লব অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছিল। দিন দিন শ্রমিকেরা আরো বেশি সংখ্যার আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে। ভাসানী আরও কড়া ভাষণ দিয়ে জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানাতে থাকেন। তিনি শ্রমিকদের 'ঘেরাও' কৌশল (মালিকদের চাপে রাখা) প্রয়োগের পরামর্শ দেন। কৃষক আন্দোলন থেকে এই ট্যাক্টিকস শ্রমিক শ্রেণীতে ছড়িয়ে পড়ে।

১৭ মার্চ সফলভাবে সারাদেশে হরতাল পালিত হয় যা প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের পদত্যাগ পর্যন্ত হরতাল অব্যাহত থাকে।

পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে কৃষকরা জমি দখল শুরু করে এবং ঘৃণিত জমিদারদের বিচারের জন্য আলাদা আদালত গঠন করে। তাদের স্লোগান হয়ে ওঠে 'লাঙল যার জমি তার' এবং 'জমিদার নিপাত যাক'।

পূর্ব পাকিস্তানে ২৪টি ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটে যেখানে শ্রমিকরা বড় কারখানা ও সরকারি ভবন দখল করে নেয়। অধিকাংশ কর্মস্থলে শ্রমিকদের স্ব-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়।

আইয়ুব খান আতঙ্কিত হয়ে বললেন: "প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো অচল করা হচ্ছে, ইচ্ছেমতো ঘেরাও করে জোরপূর্বক তাদের দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে। (...) পরিস্থিতি এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান জবরদস্তীর ও ভয়ের শিকার। (...) দেশের প্রতিটি সমস্যার সমাধান রাস্তায় নির্ধারিত হচ্ছে।"

তিনি সঠিক বলেছিলেন! সমাজে রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি কর্তৃত্বসম্পন্ন একটি পৃথক শক্তি বিদ্যমান ছিল। তা ছিল শ্রমিক শ্রেণীর শক্তি যা তাদের কারখানা কমিটির মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছিল।

সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে অনুরূপ পরিস্থিতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল। ২৫ মার্চ আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় যা এই রাজপথ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা বিপ্লবের শক্তির প্রদর্শন।

পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) বামপন্থী পপুলিস্ট নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

যদি ভাসানী ও ভুট্টো বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতা দখল করতেন, তাহলে সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে কারখানা কমিটির ভিত্তিতে একটি শ্রমিক সরকার গঠনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হত।

এই পরিস্থিতিতে বাঙালি জনগণকে স্বেচ্ছায় একটি শ্রমিক-নেতৃত্বাধীন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়া অথবা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে স্বাধীনতা বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া সম্ভব হত। শ্রমিক নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় ঐক্যগঠন পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র ভারতে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার পথ মসৃণ করত, এবং সর্বোপরি উপমহাদেশে একটি সমাজতান্ত্রিক ফেডারেশন গঠনে ভূমিকা রাখত। যেখানে নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিঃসন্দেহে পূর্ণ স্বীকৃতি পেত।

কিন্তু ভুট্টো সক্রিয়ভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন এবং যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানের জোরপূর্বক ঐক্য এবং সঙ্গতি বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

স্ট্যালিনবাদ ও মাওবাদের বিশ্বাসঘাতকতা

ভাসানীর কখনই ক্ষমতা দখলের কোনো ইচ্ছা ছিল না। তিনি মনে করতেন প্রথমে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, তারপর সমাজতন্ত্র গড়া যাবে।

কর্মক্ষেত্র কমিটিগুলোকে নতুন সমাজের বীজ বা স্বাধীনতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে তিনি দেখেননি। বরং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী থেকে সাধারণ গণতান্ত্রিক ছাড় আদায়ের মাধ্যম হিসেবেই এগুলোকে দেখতেন।

সুতরাং 'গৃহযুদ্ধ'-এর হুমকি দেওয়া তাঁর জোড়ালো বক্তৃতাগুলো ছিল ফাঁকা বুলি, যেখানে তিনি আন্দোলনের নেতৃত্ব ধরে রাখতে ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন। এটা এসেছিল মাওয়ের চীনের প্রতি তাঁর আনুগত্য থেকে।

১৯৬৫ সালে চীনা আমলাতন্ত্র সংকীর্ণ স্বার্থে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়, যা চীন-সোভিয়েত বিভাজনের সৃষ্টি করে। এর ফলে সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোতে বিভক্তি দেখা দেয়।

আন্তর্জাতিক বিপ্লবের ডাক দেওয়া ও পুঁজিবাদ বিরোধী বিশ্বব্যাপী সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বদলে তারা বিশ্ব মঞ্চে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে মত্ত হয়। এমনকি একে অপরকে দুর্বল করতে পুঁজিবাদী শাসকদের সাথে হাত মেলায়।

সোভিয়েতের প্রভাব ঠেকাতে চীনের আমলাতন্ত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে নীতিহীন জোট বাঁধে, যা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সাথেও যুক্ত হয়।

এই কৌশলের অংশ ছিল তাদের মদদপুষ্ট কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। ভাসানীর ন্যাপ ও বাংলাদেশের মানুষ ছিল তাদের স্বার্থান্বেষী খেলার পুতুল।

এটি ভাসানীকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থানে ফেলে দেয়। একদিকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অন্যদিকে মাও ও চীন তাদের বন্ধু আইয়ুব খানের মতো নিপীড়ককে সমর্থন করছেন।

ভাসানীর সহকারী স্মৃতিচারণ করেন, মাওয়ের সাথে সাক্ষাতের পর তিনি উৎসাহিত না হয়ে বরং বিষণ্ণ ও হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি আগের মতো থাকেননি।

স্ট্যালিনবাদের প্রভাবে সব বাম দল 'টু স্টেজ তত্ত্ব' (Two-stage Theory) তত্ত্বের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে। এই তত্ত্বে বলা হয়েছিল, বিপ্লবের ধরণ হলো বুর্জোয়া (বুর্জোয়া শ্রেনীর অসমাপ্ত ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন করা) , তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব নয়—দীর্ঘ সময়ের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পরই কেবল তা সম্ভব। এই কাল্পনিক 'প্রগতিশীল বুর্জোয়া' খোঁজার নামে কমিউনিস্টরা অদ্ভুত ও নীতিহীন জোটে জড়িয়ে পড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মাওবাদী গ্রুপ বাঙালি জাতীয়তাবাদীর প্রশ্নকে উপেক্ষা করেছিল বা বিরোধিতা করেছিল। কিছু বাম দল আইয়ুব সরকারকে 'প্রগতিশীল' আখ্যা দিয়েছিল, কারণ তখন শিল্পায়ন হচ্ছিল। তারা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকে 'সিআইএ'র (CIA) ষড়যন্ত্র' বলে চালাত!

স্ট্যালিনবাদী ও মাওবাদী 'কমিউনিস্ট' দলগুলোর এই রাজনৈতিক ব্যর্থতার ফলেই পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে ভুট্টো ও মুজিব আন্দোলনের নেতৃত্ব দখল করতে পেরেছিলেন।

শাসন ও স্নেহ নীতি

সারা দেশ সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছিল, এবং শাসক শ্রেণি সংবিধান স্থগিতকরণ ও সামরিক শাসন জারি করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবি করে। কিন্তু আইয়ুব নিজে এটি জারি করতে পারেনি কারণ তাঁর কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তাই সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

আইয়ুব যদি শাসন করে থাকেন, ইয়াহিয়া এসে স্নেহের আশা দেখালেন অর্থাৎ আইয়ুব খান শাসক কায়দায় অত্যাচার করতেন অন্যদিকে ইয়াহিয়া এসে দেখালেন নির্বাচনের লোভ। তিনি সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন এবং ট্রেড ইউনিয়নের ছোট-খাটো সংস্কারের ঘোষণা দেন। তাদের আশা ছিল আন্দোলনকে নিরাপদ সীমার মধ্যে রাখা।

এটি কাজ করল। অনেক বাঙালির কোনকালেই এমন রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভিজ্ঞতা ছিল না।

বিপ্লব কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় ভাসানী তাঁর প্রভাব হারাতে শুরু করেন। তখন 'বুলেট না ব্যালট'—অর্থাৎ নির্বাচন নাকি সশস্ত্র বিপ্লব? এই নিয়ে বিতর্ক চলছিল। কিন্তু ভাসানীর বিপ্লবের ধারণা সীমাবদ্ধ ছিল মাওবাদী কৃষক গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে।

প্রকৃতপক্ষে, তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দলীয় নেত্রী কানিজ ফাতেমা পরে আমাদের এক কমরেডকে করাচি সফরকালীন সময়ে একটি ঘটনা বলেছিলেন। করাচি তখন এবং এখনও দেশের সর্বাধিক শিল্পায়িত ও শ্রমিক অধ্যুষিত শহর। সেখানে গিয়ে ভাসানী দলীয় সদস্যদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, "করাচির কাছে কোনো পাহাড় আছে কি?" তারা বলল, "না"। তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, সেখানে বিপ্লব সম্ভব নয়!

স্বাধীনতার জন্য স্পষ্ট কৌশল দিতে না পেরে ভাসানী ও তাঁর দল ন্যাপ নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন। তাঁর যুক্তি ছিল, নির্বাচন পাকিস্তানকে আরও শক্তিশালী করবে, এবং প্রথমে ক্ষুধা ও স্বাধীনতার প্রশ্ন সমাধান করতে হবে। কিন্তু তখন জনআন্দোলনে ভাটা পড়তে শুরু করেছিলো, আর নির্বাচনের প্রতি মানুষের ভ্রান্ত আশা বাড়ছিলো। বিপ্লবের উপযুক্ত বিকল্প না দেখিয়ে নির্বাচন বয়কট করা তখন অর্থহীন কৌশল ছিল। এভাবেই মুজিবের আওয়ামী লীগের জন্য পথ আরও সুগম হলো ।

এই পরিস্থিতি লড়াইয়ের পথকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রত্যাখ্যাত করলো। এতে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, মুজিব তা পূরণে আগ্রহী ছিলেন।

এই মুহূর্তে মূল প্রশ্ন ছিল বিপ্লবের চরিত্র/পর্যায়/স্তর কী হবে। জনআন্দোলন সমাজতান্ত্রিক রূপ নিলেও, এমনকি যখন পরিস্থিতি তাকে সামনাসামনি দাড় করালেও ভাসানী তা মানতে রাজি ছিলেন না!, তাদের সব কৌশল ভিত্তিহীন 'টু স্টেজ তত্ত্ব' (Two stage theory) থেকে আসছিল।

নির্বাচন.

বাঙালিদের উপর জাতিগত নিপীড়ন থেকে শ্রেণি-সংগ্রামের ভিত্তিতে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠে। সমাধান ছিল শুধু সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সমগ্র জাতির ক্ষমতা দখল। কিন্তু শ্রমিক নেতৃত্ব তা করতে অস্বীকার করায় বাঙালি শ্রমিকরা মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদীদের শ্রেণিস্বার্থের হাতিয়ার হয়ে যায়।

মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ছিল উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের দল। এর নেতৃত্বের বেশিরভাগ ছিলেন ব্যবসায়ী ও ছোট-মাঝারি জমির মালিক। দলটি সমাজের এই স্তরের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।

তারা জনআন্দোলনের ঢেউকে ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে সুবিধে আদায় করতে চেয়েছিল। জনগণের মনের প্রতিফলন হিসেবে তাদের ভাষা খুব জোরালো হলেও, তারা সংগ্রামের পুরোটা পথ পাড়ি দিতে ছিলো অপারগ এবং অনিচ্ছুক। তাদের পুরো কৌশল ছিল আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা।

বাস্তবে, জাতীয় মুক্তির গনআন্দোলন সম্পত্তির মালিকানার প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কৃষকরা জমি দখল করছিল, শ্রমিকরা কারখানা দখল করছিল। এতে আওয়ামী লীগের মধ্যবিত্ত নেতারা ভয় পেয়েছিল। তারা সঠিকভাবেই আশঙ্কা করেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে শ্রেণি সংগ্রাম আরো শানিত হবে এবং পুঁজিবাদ উচ্ছেদের দিকে যেতে পারে।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আশা করেছিল, পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ ভোট জাতীয়তাবাদী, ইসলামপন্থী ও কৃষক দলে বিভক্ত হবে। এতে তারা 'বিভাজন ও শাসন' নীতি চালিয়ে জনগণের মনোবলহীন করার মতলবে ছিল।

দুর্ভাগ্যবশত, তাদের হিসাবে ভুল ছিল। দশকের পর দশক ধরে চরম দারিদ্র্য ও জাতীয় নিপীড়নের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি বাঙালিদের গভীর ঘৃণাকে তারা সবসময়কার মত অগ্রাহ্য করেছিল।

কোনো রাজনৈতিক বিকল্প না থাকায়, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর মুজিবের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টির মধ্যে ১৬০টি আসন জিতে নেয়। এটি শুধু পূর্বাংশেই নয়, সমগ্র পাকিস্তানে ৩৯.২% ভোট নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দেয়!

এই ফলাফল শাসকগোষ্ঠীদের হতবাক করে। এটি ছিল কার্যত স্বাধীনতা ও পাকিস্তান ভাঙনের পক্ষে জনম্যান্ডেট।

মুজিব তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় পরিষদ আহ্বানের দাবি জানান, যেখানে আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।

বিপ্লবের পুনর্জাগরণ

পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি ও জমিদাররা কখনোই স্বাধীন বাংলাদেশ মেনে নিতে পারত না। এর মানে ছিল উপনিবেশ হিসেবে বাংলাদেশের মত একটা কলোনি হারানো এবং তাদের অতিরিক্ত মুনাফার সমাপ্তি। এছাড়াও এটি পাকিস্তানের অন্যান্য নিপীড়িত জাতিগুলোর সংগ্রামকে উৎসাহিত করতো। তাছাড়া, ভারত-বন্ধুত্বপূর্ণ একটি বাংলা রাষ্ট্র ও তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী পাকিস্তানের আঞ্চলিক অবস্থানকে দুর্বলতর করতো।

বাঙালিদের চরম শোষণ এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের জাতীয় নিপীড়ন একসাথে জড়িত ছিল। এমতাবস্থায় পুঁজিপতিদের উৎখাত করাই ছিল একমাত্র সমাধান।

কিন্তু মুজিব পুঁজিবাদ বিরুদ্ধে গিয়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমা ছাড়িয়ে যেতে রাজি ছিলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা কোনো ছাড় দিচ্ছে না দেখে তিনি হতবাক হয়েছিলেন, এমনকি বলেছিলেন: "ওরা কি বুঝছে না, আমিই একমাত্র তুরুপের তাস যে কমিউনিস্টদের থামাতে পারি?" (লরেন্স লিফশুলৎস, বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভোলিউশন, ১৯৭৯) .

অর্থাৎ, মুজিবের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। বরঞ্চ, তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়াই একটি দুর্বল চুক্তি চেয়েছিলেন, যেখানে বাঙালি বুর্জোয়ারা কিছুটা স্বায়ত্তশাসন পেয়ে স্থানীয় শ্রমিক-কৃষকদের শোষণের সুযোগে ভাগ পাবে। বুর্জোয়ারা সর্বদা শ্রমিক শ্রেণিকে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়েও বেশি ভয় পায়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে সবকিছু খোয়ানোর চেয়ে তারা অন্য বুর্জোয়ার অধীনতা মেনে নিতে রাজি, যদি তাদের কিছু সুবিধা বজায় থাকে।

১ মার্চ ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ স্থগিত করেন, যা বাঙালি জনতার ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার মত অবস্থা।

এই খবর ছড়িয়ে পড়লে এক প্রত্যক্ষদর্শী ক্রিকেট মাঠের দৃশ্য বর্ণনা করেন:

"ট্রানজিস্টর রেডিওতে সংসদীয় পরিষদ স্থগিতের সংবাদ শুনে দর্শকরা রেডিও হাতেই মাঠ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ৪০-৫০ হাজার মানুষ স্টেডিয়াম ছেড়ে রাস্তায় 'জয় বাংলা' স্লোগান দিতে থাকে। হোটেলের সামনের রাস্তাগুলো লোহার রড ও বাঁশের লাঠি নিয়ে মানুষে ভরে যায়। পাকিস্তানি পতাকা ও জিন্নাহর ছবি পোড়ানো হয়।"

প্রতি-বিপ্লবের চেষ্টা বিপ্লবকে নতুন করে শক্তি যোগায়। আওয়ামী লীগ র‍্যাডিকাল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের চাপে হরতাল ডাকে।

"রাস্তার যানবাহন, দোকান-পাট, কারখানা, অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়। সবাই আন্তরিকতার সাথে হরতালে যোগ দেয়... এমনকি মাছ-সবজির বাজারও বন্ধ থাকে।" (জাহানারা ইমাম, একাত্তরের দিনগুলি)

প্রতিক্রিয়াস্বরুপ, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কারফিউ জারি করে এবং সরকারবিরোধী সংবাদ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু জনতা কারফিউ অমান্য করে।

ব্যারিকেড দেয়া হচ্ছিল, আর জনতা দিনরাত পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। বামপন্থী ছাত্র নেতারা মুজিবকে ৩ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। তিনি একটি প্রেস কনফারেন্স করেন, যেখানে সবাই তাঁর কাছ থেকেই ঘোষণা আশা করেছিল। কিন্তু তারা হতাশ হয়ে ফিরে যায়। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার বদলে ‘অহিংস অসহযোগ’ এর ডাক দেন।

এই কনফারেন্সের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “তিনি কিছুই বলেননি। কিন্তু তাকে দেখতে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছিলো।” (জাহানারা ইমাম, একাত্তরের দিনগুলি, ১৯৮৯)

ছাত্র নেতারা এরপর নিজেরাই পল্টন ময়দানে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে ‘স্বাধীনতার কর্মসূচি’ পাঠ করেন। প্রধান ছাত্র নেতা আ স ম আবদুর রব উল্লসিত জনতার সামনে নতুন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন।

মুজিব দ্রুত পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলেন এবং সবকিছু তাঁর চিন্তাভাবনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো।

রাস্তার সংঘর্ষ পরেও অব্যাহত থাকে। ৭ মার্চ মুজিবের একটি প্রত্যাশিত ঘোষণার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ৩ লাখ মানুষ জড়ো হয়। কিন্তু “শেখ (মুজিব) সবাইকে আবার হতাশ করলেন।” (Of Blood and Fire: The Untold Story of Bangladesh's War of Independence, ১৯৮৯)

স্বাধীনতা আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়, সমাবেশ, এমনকি ঘরোয়া আলোচনায় দিনরাত তীব্র বিতর্ক চলছিলো।

বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী কবিতা, গান, কার্টুন ও স্টিকার তৈরি করে ব্যাপকভাবে বিতরণ করা হচ্ছিল। ঢাকা টেলিভিশনের কর্মীরা স্টেশন দখল করার পর প্রতি ঘণ্টায় নতুন বিপ্লবী শিল্পকর্ম প্রদর্শন করছিল, যা হাজারো মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে, জনতা আওয়ামী লীগের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ছাড়িয়ে বিপ্লবী উপায়ে কাজ শেষ করতে চেয়েছিল।

আন্দোলন তখন অপ্রতিরোধ্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলো। সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, পেশাজীবী সংগঠন ও শিল্পী গোষ্ঠী ২৩ মার্চ ‘প্রতিরোধ দিবস’ নামে একটি বিশাল বিক্ষোভের ডাক দেয়।

এটিই ছিল সেই মুহূর্ত যখন সময় এসেছিল সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেবার ও ক্ষমতা দখল করার। জনতা এই দিনটির জন্যেই অপেক্ষার প্রহর গুনছিল।

এটা তখন স্পষ্ট হয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি ও জমিদারদের উচ্ছেদ না করে ১১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

ধনী পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনোই স্বেচ্ছায় ব্যাংক, শিল্প, জমির মালিকানা ছাড়বে না বা উদার গণতন্ত্রের বিকাশ হতে দেবে না।

যদি একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিটি কর্মক্ষেত্র, সম্প্রদায় ও গ্রামে শিকড় গেড়ে থাকত, তাহলে তারা হরতালকে পশ্চিম পাকিস্তানি জমিদার ও পুঁজিপতিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, ব্যাংক ও অর্থনীতির মূল খাত শ্রমিক নিয়ন্ত্রণে জাতীয়করণ করার মধ্যেই প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের দিকে নিয়ে যেতে পারত।

তবে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাবে, বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ সেই দিনটি একটি গণউৎসব হিসেবেই শেষ হয়। ক্ষমতা দখলের সুযোগ আবারও হাতছাড়া হয়ে গেলো। যার ফলাফল হিসেবে একটি ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছিলো ।

কালো রাত

২৫ মার্চ ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ জেগে ওঠে “ভারী কামানের গর্জন, মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার ও বুলেটের শব্দ শুনে”। “কান ফাটানো আর্তচিৎকার ও নিহতদের আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল।” (জাহানারা ইমাম, একাত্তরের দিনগুলি, ১৯৮৯)

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘কালো রাত’ নামে কুখ্যাত এই রাতে অভিযানের শুরু করেছিল যেন বিপ্লবকে তারা রক্তের নদীতে ডুবিয়ে দিতে পারে। অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয় এবং মুজিবসহ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এটি ছিল নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংস সামরিক হস্তক্ষেপ।

ইসলামি মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিবিপ্লবী বাহিনী গঠনে সৈন্য সরবরাহ করে। এই গোষ্ঠীগুলি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে মিলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে হত্যা ও যৌন সহিংসতা চালায়।

বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে বিরাট এক গণহত্যা সংঘটিত হয়। মৃতের সংখ্যা অজানা, তবে বিভিন্ন মতামত অনুসারে আনুমানিক ৩ লাখ থেকে ৩০ লাখ। হাজার হাজার বাঙালি নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং ৮৯ লক্ষ (প্রায় ১ কোটি) মানুষ শরণার্থীতে পরিণতি হয়।

বাঙালি জনগণকে এই মূল্য দিতে হয়েছিল শুধুমাত্র তাদের কাপুরুষোচিত ও দ্বিধাগ্রস্ত নেতৃত্বের দরুণ।

মুজিবের দুর্বল ও অনিশ্চিত নীতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে এই আক্রমণের সুযোগ করে দিয়েছিলো ।

ক্ষমতা যদি শ্রমিক ও কৃষকের হাতে না যায়, তাহলে একটি কোণঠাসা জীর্ণ ও নিষ্ঠুর শাসক শ্রেণির হিংস্রতাই হয় শেষ পরিণতি।

মুজিবের গণতান্ত্রিক সীমার মধ্যে দাবি রাখার নীতি জনতাকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা করেছিল।

এই অনিবার্য ঘটনার জন্য কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি: জনতা নিরস্ত্র ছিল, ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ নৃশংস পরিস্থিতিতে মারা যায়। কোনো শাসক শ্রেণি বা গোষ্ঠী কখনোই আক্রমণ ছাড়া ক্ষমতা ও বিশেষাধিকার ছাড়ে না।

মুজিব নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেপ্তার হতে দিয়েছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্তও তিনি ইয়াহিয়ার কাছে আপোষের আবেদন করে যাচ্ছিলেন। তিনি এমনকি একটি ম্লান স্বাধীনতা কর্মসূচিও মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন, যা কার্যত পাকিস্তানের অধীনতাই বজায় রাখত।

জনআন্দোলনের মুখোমুখি হওয়ার পর ক্ষুদ্র বুর্জোয়া নেতৃত্ব তখনই বিশ্বাসঘাতকতা করে যখন তা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ ছাড়িয়ে যায় এবং যখন তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হুমকির মুখে পড়ে। ১৭৯৮ সালের আইরিশ বিদ্রোহের নেতা হেনরি ম্যাকক্র্যাকেনের ভাষায়, "ধনীরা সর্বদা গরিবদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।"

মুক্তিবাহিনী গঠন

পাকিস্তানিদের এই সামরিক অভিযান একটি উদীয়মান বিপ্লবী জোয়ারকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। অনেকেই মাথা নিচু করে পরিবারকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো বা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো।

কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মত চীনের প্রথম প্রিমিয়ার চৌ এন লাই ১৩ এপ্রিল ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খানকে চিঠি লিখেন: "চীনা সরকার ও জনগণ পাকিস্তান সরকার ও তার জনগণের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার ন্যায্য সংগ্রামে অবিচল সমর্থন দেবে।" তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তাও দেবে।

এটি ছিল সেইসব মানুষের জন্য মর্মান্তিক বিশ্বাসঘাতকতা যারা মাওয়ের চীনকে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে দেখত। এতে বিপুল সংখ্যক তরুণ-যুবা বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে।

কিন্তু পর্দার আড়ালে, জুনিয়র অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের একটি বড় অংশ নিজ জনতার উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বর্বরতার বিরুদ্ধে জাগরিত হয়ে বিপ্লবী হয়ে উঠেছিল।

এমনই একজন চৌকস অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট আবু তাহের, যিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে প্রতিরোধে যোগ দেন এবং ১১তম সেক্টরের সাব-কমান্ডার হন (জিয়াউর রহমানের অধীনে)। স্বাধীনতা-পরবর্তী বিপ্লবী ঘটনাবলীতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও ছিল।

তারা গ্রামে গিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করে, যেখানে একে একে যোগ দেয় সংকল্পবদ্ধ ও ত্যাগী সব যুবকেরা। তারা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে।

অনেক নারী আলাদা ইউনিটে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন।

নারীরা গুপ্তচর হিসেবে, নানান সরবরাহ বহন করে, আহতদের সেবা করে এবং ঘরবাড়িগুলোকে অস্থায়ী হাসপাতালে পরিণত করে সহায়তা করে যাচ্ছিল নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই।

নারীদের ভূমিকা ছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অপরিহার্য!

বিপ্লবী অফিসারগণ

১০ এপ্রিল ১৯৭১-এ কলকাতায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠিত হয়।

তারা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী ও সামরিক কমান্ডারদের একটি স্তরকে অনুপ্রেরণা যোগান। তারা ভারতীয় রাষ্ট্রের সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর 'অফিসিয়াল' কমান্ড সমন্বয় করেন।

এই 'অফিসিয়াল' কমান্ড গঠিত হয়েছিল প্রবাসী আওয়ামীলীগ সরকারের সাহায্যে কিছু বাঙালি সামরিক অভিজাতদের নিয়ে, যারা প্রচলিত ধারার কাঠামোর মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চেয়েছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য তাদের সৈন্য সংখ্যা কম থাকায়, ৩রা ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনী একত্রিত হয় মিত্র বাহিনী গঠন করার মধ্য দিয়ে।

ভারতীয় রাষ্ট্র মুখে বাঙালি স্বাধীনতার সমর্থন করলেও তাদের বাস্তব স্বার্থ ছিল স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে।

তারা এই ভয়ে ছিলো যে এই আন্দোলন প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ ও পরে সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তারা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, কারণ এটি দক্ষিণ এশিয়ায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারতো।

তবে তারা বাংলাদেশ দখল করে ভারতের সাথে যুক্ত করতে চায়নি। এতে আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি ছিল।

তাদের সর্বোচ্চ আশা ছিল ভারতীয় পুঁজিপতিদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি বাংলাদেশ গঠন, যা পাকিস্তানকে দুর্বল করতে ভারতবর্ষে তাদের আঞ্চলিক কৌশলে ভূমিকা রাখবে।

আসলে ১৯৭১-এর পর ভারত পাকিস্তানের উপর চূড়ান্ত পরাজয় চাপিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর জন্য ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে একটি সীমান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়োজন ছিল, যাতে জনগণের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। এটি ছিল ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিভাজন নীতিরই ধারাবাহিকতা ।

পরে মুক্তিবাহিনীর মধ্যেই প্রতিরোধের পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে বিরোধী প্রবণতা দানা বাধতে শুরু করে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করা অফিসিয়াল কমান্ডের প্রধান অংশের নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী। ত্রিপুরায় অপারেশনাল কমান্ডে ছিলেন খালেদ মোশাররফ, উত্তর ব্রিগেডের নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান—যিনি স্বাধীনতা পরবর্তীতে প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা নেন।

অন্যদিকে, আবু তাহেরের মতো বিপ্লবী অফিসাররা ভারতীয় সহায়তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং যুদ্ধকে গ্রাম কমিউনের ভিত্তিতে বিপ্লবী স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপ দিতে চাচ্ছিলেন।

এটি ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অতি বাম ঘরানার অবস্থান, যারা পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) গঠন করে। তারা সচেতনভাবে কর্মীদের গ্রাম ও শহরে পাঠিয়ে কৃষক ও যুবকদের মুক্তিবাহিনীতে যুক্ত করার চেষ্টা করে।

সামরিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক বার্তার মাধ্যমে তাহের মুক্তিবাহিনীর নন-অফিসারদের মধ্যেও বিশাল কর্তৃত্ব গড়ে তুলেছিলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিনি চিলমারীতে সফল অভিযান চালিয়ে উত্তর বাংলায় পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেন।

এরপর তিনি তার নজর দেন গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক চালঃ কামালপুর দখল করা(২৪ অক্টোবর), যা ১৪ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীদের অধীনে আসে। এই যুদ্ধ-অংশগ্রহণরত অবস্থায় তাহের একটি পা হারান (মাইন বিস্ফোরণের মাধ্যমে)।

তাহেরের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ ছিল কৃষক ও যুবকদের নিয়ে গঠিত বিপ্লবী বাহিনী দিয়ে ঢাকায় চূড়ান্ত আঘাত হানা।

বাঙালি সামরিক সিনিয়র-কমান্ডরা, প্রবাসে নির্বাসিত আওয়ামীলীগ সরকার ও ভারতীয় শাসকশ্রেণী তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল, যদি তাহের ১ লক্ষ বিপ্লবী যোদ্ধা নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান, তাহলে তারা কিউবার বিদ্রোহী বা চীনের লাল বাহিনীর মতো মুক্তিদাতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন। এটি ভারতীয় পুঁজিবাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতো যারা নিজেরাই তখন অর্থনৈতিক সংকটে ছিল। পশ্চিমবঙ্গে শ্রেণি সংগ্রাম নিয়ন্ত্রণে রাখাও তাদের জন্য কঠিন হচ্ছিল।

একটি অগ্রসরমান বিপ্লবী বাহিনী সমগ্র উপমহাদেশে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী এটি মেনে নিতে পারেনি, তাই ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ তারা ১.৫ লক্ষ সৈন্য পাঠায়, যারা মুক্তিবাহিনীর আগেই ঢাকায় পৌঁছে যায়।

ভারতীয় হস্তক্ষেপ শাসকগোষ্ঠীদের রক্ষা করে। প্রথম চালেই তারা যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ন্ত্রণ করে নেয়: গ্রাম কমিউন ভেঙে দেয় ও বামপন্থী গেরিলাদের নিরস্ত্র করে ফেলে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় জনগণের রোষানল থেকে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাঁচিয়ে দেয়, যাদেরকে যুদ্ধাপরাধের জন্য শাস্তি পেতে হতো। জনগণের প্রতিশোধ পুরো অঞ্চলের শাসকদের জন্য সতর্কবার্তা বয়ে নিয়ে আসতো।

পরিবর্তে, ভারতীয় ও পাকিস্তানি জেনারেলরা একসাথে খোশালাপ দিতে শুরু করে। তারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে একসাথে কাজ করার দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে। প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের পরিবারকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ভারতে আনা হয়।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করলে জনতা রাস্তায় নেমে জয় বাংলা স্লোগান ও স্বাধীনতার পতাকা নিয়ে উদযাপন করে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ঢাকায় উল্লাসের সাথে স্বাগত জানানো হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে জনতা তখন যেকোনো উপায়ে যুদ্ধ থামাতে রাজি ছিল, এমনকি কোন বিদেশি সেনা আক্রমণেও!

যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে জাহানারা ইমাম যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতি সংক্ষেপে বলেছেন:

"টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন এখনও মেরামত হয়নি। কে করবে এটা? পুরো শহর একসাথে হাসছে আর কাঁদছে। মানুষ সব খুশি কারণ তারা শেষ পর্যন্ত মুক্ত, কিন্তু রক্তের বিনিময়ে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা অনেক বিশাল।"

হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা কেমন হবে, আর কোন ভিত্তিতে তা গড়ে উঠবে?

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুজিবকে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসায়, যারা আশা করেছিল তিনি তাদের স্বার্থে অর্থনীতিকে গড়ে তুলবেন।

বাঙালি জনগণের চোখে তাঁর এখনও কর্তৃত্ব ছিল, আর ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিত ছিল যে তিনি তাদের স্বার্থ রক্ষায় নির্ভরযোগ্য গুটি।

মুজিবের জন্য, তিনি যা চেয়েছিলেন তা পেয়েছিলেন। তিনি 'আইন-শৃঙ্খলা' ফিরিয়ে আনা ও 'ওয়েস্টমিন্সটার ধাঁচের গণতন্ত্র' বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন।

কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ বর্বরতার খাঁদে ঢলে পড়ে। অর্থনীতি তখন সম্পূর্ণভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে।

দেশের অবকাঠামো তখন একদম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ৩০০টিরও বেশি রেল ও ২৭০টি সড়ক সেতু ক্ষতিগ্রস্ত, প্রায় ১ কোটি (তথা ১০ মিলিয়ন) মানুষ পৈতৃক-ভিটা ছাড়া, কারখানা ও খামার অচল, তার উপর বন্যা ও দুর্ভিক্ষে সব জমি বিধ্বস্ত তখন।

যুদ্ধের স্বতন্ত্র প্রকৃতির কারণে, যদিও এই যুদ্ধের সমাপ্তি ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছিল, তবুও যুদ্ধের মাধ্যমে তখন একদল শক্তিশালী পশ্চিম পাকিস্তানী জমিদার ও পুঁজিপতিদের জোর করে তাড়ানো হয়, এবং এই জন্য বিপুল পরিমাণের জমি ও কারখানা ফাঁকা পড়ে যায়।

বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণি এই শূন্যতা পূরণ করতে অক্ষম ছিল, তাই মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকার ৯৩% শিল্প, ৮০% আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সব স্থানীয় ব্যাংক জাতীয়করণে বাধ্য হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের উৎখাতের ভিত্তিতেই কেবল আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। তবে একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি থাকলে তুলনামূলক ভাবে অল্প রক্তপাতেই এটি করা যেত।

কিন্তু মুজিবের মতো ‘র‍্যাডিকেল’' পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরাও প্রমাণ করলেন, তারা স্বেচ্ছায় কোনকিছু করতে সক্ষম ছিলেন না বরং পরে বাধ্য না করলে সেটাও (স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া) করতেন না। তারা আন্দোলনের লাগাম টেনে ধরেছিলেন।

মুজিব ও আওয়ামী লীগের সিদ্বান্তহীনতা থাকার পরেও স্বাধীনতা এসেছিল।

জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণেই কেবল প্রত্যেক স্তরে আন্দোলন সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র অদম্য বিপ্লবী ইচ্ছাশক্তির কারণেই তারা তাদের নেতাদের ছাড়িয়ে গিয়ে স্বাধীনতার পথ পাড়ি দিয়েছিলো।

মুজিব ও আওয়ামী লীগের ভীরুতা ও টালবাহানার কারণেই মূলত পশ্চিম পাকিস্তানিদের উৎখাত করতে ৯ মাস ব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং প্রায় ১ কোটি প্রাণকে মূল্য দিতে হয়েছিলো।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ/জে.এস.ডি)

মুজিব যাবার সময় যেমন দেশ রেখে গিয়েছিলেন তার থেকে ভিন্ন অবস্থার দেশে ফিরলেন। দেশ তখন যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত। .

বেশিরভাগ শিল্প জাতীয়করণ হলেও, মুজিব ও শাসকগোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য ছিল শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও স্থানীয় বাঙালি পুঁজিপতি শ্রেণি গড়ে তোলা।

তিনি মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেন এবং পূর্বের শাসনব্যাবস্থার ৮০% আমলাকে পুনর্বহাল করেন, যাদের অধিকাংশই হীনভাবে পাকিস্তানি শাসনব্যাবস্থাকে সহযোগিতা করেছিল!

ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ, বিপ্লবী অফিসারদের শুদ্ধিকরণের তাগিদে লে. কর্নেল তাহেরকে সামরিক পদ থেকে অপসারণ করা হয়।

মুজিব সেনাবাহিনীর উপর ভরসা করতে পারছিলেন না, কারণ তারা হয় পাকিস্তানের সহযোগী ছিল নয়তো বামপন্থী। তাই তিনি নিজের প্রতি অনুগত একটি আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করেন—জাতীয় রক্ষী বাহিনী (জেআরবি)।

জেআরবি তখন বেশ অশ্রুসজল ও ভয়াবহ নৃশংসতা চালায়। চোরাচালান ও কালোবাজারি বন্ধের নামে তাদের মূল কাজ ছিল বামপন্থী সংগঠনগুলিকে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা।

এপ্রিল ১৯৭২-এ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অতি-বামপন্থীরা ও মুক্তিবাহিনীর সকল যোদ্ধারা আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গোপনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ / জে.এস.ডি) গঠন করে।

দলের কর্মীরা মূলত ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকের বিপ্লবী ছাত্র নেতাদের নিয়ে গঠিত। দলটি গঠন করেন তৎকালীন গোপন বিপ্লবী সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলাম খান এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রভাবশালী নেতা আ স ম আবদুর রব।

পদচ্যুত হওয়ার পর, আবু তাহের ও অন্যান্য বিপ্লবী অফিসার জাসদে যোগ দেন, যেখানে তারা দলের সশস্ত্র সামরিক শাখা বিপ্লবী গণবাহিনীর নেতৃত্ব দেন।

তাহের আরও র‍্যাডিকেল সিদ্ধান্তে পৌঁছান এবং নিজেকে মার্ক্সবাদী বলে দাবি করেন। সামরিক এলিটদের দুর্নীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনে বিরক্ত হয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, সমাজের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ছাড়া বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন একেবারে অসম্ভব!

স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনীতি

আওয়ামী লীগ মূলত ছোট-মাঝারি ধরনের জমি ও ব্যবসার মালিকদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল। এই মধ্যবিত্ত আমলারা স্থানীয় পুঁজিপতি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। তারাই রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলে।

জাতীয়কৃত শিল্প দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অপচয়ে সয়লাভ হয়ে গেলো। বড় কোম্পানির কর্তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প পরিচালনায় আবার ফিরিয়ে আনা হয়।

বহির্বিশ্বের পাঠানো সাহায্য আওয়ামী লীগ নেতারা পকেটস্থ করতেন। উদাহরণস্বরূপ, আওয়ামী লীগের ঢাকা সভাপতি ও রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা কোটি কোটি টাকার কালোবাজারি ব্যবসা গড়ে তোলেন। রেশনিং চালু করা হয়, যা ইঙ্গিত করে সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করে লাভবান হতো। .

চোরাচালান কোটি টাকার ব্যবসায় পরিণত হয়। সরকার 'মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট' দেয়ার ব্যবস্থা করলো যা অনেককে রেশনে অগ্রাধিকার দেয়। এই রেশন সুবিধা তাদের অব্দি না গিয়ে কালোবাজারেই বিক্রি হতো। এমনকি পাকিস্তানি সহযোগীরাও (যুদ্ধাপরাধী/রাজাকার) এসব সার্টিফিকেটের সুবিধা পেয়ে যায়।

একে তো যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির তার উপর দেশের ইতিহাসের ভয়াবহ বন্যা ১৯৭৪-এ আঘাত হানে, তার পরিণাম হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যেই দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়!

১৯৭৪-৭৫ সালে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫১%। চালের দাম আকাশছোঁয়া, জীবনযাত্রার ব্যয় চারগুণ বেড়ে যায়, কিন্তু মজুরি মাত্র দ্বিগুণ বাড়ে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের খোলাখুলি দুর্নীতি জনগণকে অসহ্য করে তোলে যারা অকল্পনীয় কষ্টের ভেতর জীবনযাপন করছিল। মুজিব জাতীয় নায়ক থেকে দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হন।

এই শাসন প্রথম দিন থেকেই সামাজিক সংকটে জর্জরিত। আওয়ামী লীগের ভেতরেই দলীয় বিরোধ ছড়ায়।

১৯৭৩-এর ডিসেম্বরে জাসদ ১ লাখ মানুষের বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সেবার দুটি হরতাল ডাকা হয়। মার্চে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবনে ভুখা-মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে ৩০ জন শহীদ হয়—যা মিন্টো রোড হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।

১৯৭৪-এর ডিসেম্বরে ঈদ উদযাপনকালে একজন সংসদ সদস্য নিহত হলে এই ঘটনার অজুহাতে সরকার জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

১৯৭৫-এ প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ, সংবাদপত্র ও সমাবেশের স্বাধীনতাকে অবরুদ্ধ, এবং সংসদ বিলুপ্ত করে বাকশাল নামক জোট গঠিত হয়।

একে বলা হচ্ছিল 'স্বাধীনতাপন্থী' দলগুলোর সংসদীয় জোট, কিন্তু বাস্তবে এটি মুজিবের একক নিয়ন্ত্রণে ছিল। তিনি সংসদে যেকোনো আইন ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন।

আধুনিক গণতন্ত্র তথা বুর্জোয়া গণতন্ত্র ছিল অসম্ভব। সদ্য স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরে সমস্যাগুলি এতটাই বিস্ফোরকপূর্ণ ছিল যে তা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না।

অর্থনীতি ও আইনের শাসন তখন প্রায় অনুপস্থিত । নতুন উঠে আসা বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণি তখনও দেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অক্ষম। তারা জনগণকেই ভয়ের চোখে দেখতো। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে মেহনতি জনতাকে ভোটের অধিকার দেয়ার বদলে তারা একজন শক্তিশালী নেতার পেছনে লুকিয়ে থাকতে চেয়েছিল।

১৯৭০-৭১ সালে দূরদর্শী নেতৃত্ব থেকে পিছু হটার কারণে শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা নিতে ব্যর্থ হয়, ফলে শ্রেণিগত অচলাবস্থা তৈরি হয়।

মুজিব সেই সব শ্রেণিগুলোর মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে নিজ হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন।

তিনি বাকশালকে 'দ্বিতীয় বিপ্লব' বলে চালাতে চেয়েছিলেন। এটি কোনো বিপ্লব নয়, বরং কালোবাজারি, বিদ্রোহী সেনা অফিসার ও আমলাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাঁর সমর্থন পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা মাত্র।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বাকশালের সাথে যুক্ত হয়, তারা নিজেদের পার্টি বাকশালে বিলীন করার মধ্য দিয়ে মুজিবের কাছে রাজনৈতিক অধীনস্ততা গ্রহণ করে। (পার্টি বিলীনের প্রসঙ্গে সিপিবির নেতৃত্ব এম এম অকাশ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমেরা নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে বলে থাকেন, “কমিউনিস্ট পার্টি বিলুপ্তি প্রেস রিলিজ ছিলো লোক দেখানো, তারা আসলে অতি গোপনে পার্টি কেন্দ্র ও কাঠামো রেখেছিলো। তাছাড়া পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী পার্টি সংকোচন করা ছিলো সেই সময়ের জন্যে যর্থাথ পদক্ষেপ ও কৌশল।)

কিন্তু মধ্যবিত্তদের মধ্যে মুজিবের সমর্থন তখন পর্যন্ত পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যতা তাদের ধ্বংস করেছিল। তিনি আর তাদের মুক্তিদাতা ছিলেন না।

উচ্চপর্যায়ে বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে প্রচণ্ড বিভাজন তৈরি হয়। পাকিস্তান-মার্কিনপন্থী গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতা হ্রাসে অসন্তুষ্ট হয়।

মুজিবের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ, কিছু সেনা অফিসার মুজিবের বাসভবনে ঢুকে ক্যু করার পরিকল্পনা নিয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর মতলবে হত্যা করে।

মুজিবের মৃত্যুর পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন, কিন্তু তিনি কারো আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হন।

এই আমলাদের মধ্যে অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ছিল, তাই জনগণের ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠছিল। .

জনসমর্থনশূন্য মোশতাককে ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করেন। মুজিবের প্রতি অনুগত আওয়ামী লীগ ও ভারত-মিত্র অফিসাররা এতে নেতৃত্ব দেয়।

এই অফিসারদেরও জনসমর্থন কিংবা সাধারণ সৈন্যদের মাঝে তেমন প্রভাব ছিল না—দুর্ভিক্ষ ও দুর্নীতির ধারাবাহিকতায় তাদেরও জনপ্রিয়তা আসেনি।

পরিস্থিতি কীভাবে স্থিতিশীল করা যায় সে বিষয়ে শাসকগোষ্ঠিরন মধ্যে গভীর বিভাজন তৈরি হয়।

চূড়ান্তভাবে সমাজের উপরিভাগে বিভাজন জনগণের জন্য হস্তক্ষেপ করার কিছুটা সুযোগ তৈরি করে।

বিভিন্ন ফ্যাকশনগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়। মুজিবপন্থী এই অফিসারদের পরবর্তীতে জেলে হত্যা করা হয়, পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

জিয়াউর রহমান যিনি একজন উচ্চকাঙ্খী অফিসার, তাকে আর্মির জেনারেল চিফ অব স্টাফ পদ থেকে সরিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

তখন স্পষ্ট রাজনৈতিক বিকল্পের অভাবে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই জাসদের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

অভ্যুত্থানের সময় নাগাদ জাসদ তরুণ-যুবা, কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

উপরিভাগে গভীর সংকটের দরুণ জাসদের হস্তক্ষেপ এবং ক্ষমতা দখলের সুযোগ হয়। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ তারা খালেদ মোশাররফ ও তাঁর লোকদের ঘিরে ফেলে এবং জিয়াকে জেল থেকে মুক্ত করে। তারা শ্রমিক, কৃষক ও যুবকদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানায়।

এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন সেসকল অফিসারেরা যারা বিপ্লবী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ দ্বারা উজ্জীবিত ছিলেন। তারা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করেছিলেন। এমনকি তাহের বলেছিলেন: "আমাদের বিপ্লব শুধু নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য নয়। এই বিপ্লব শোষিত শ্রেণির স্বার্থে!"

বিদ্রোহ সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। শ্রেণী বিভক্তির দরুন ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ তখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। নাহলে গৃহযুদ্ধ বা আরেকটি সামরিক একনায়কত্ব আসতো।

ওই মুহূর্তে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙ্গে পড়েছিলো । ক্ষমতা পর্যাপ্ত জনসমর্থন থাকা জাসদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল।

দুর্ভাগ্যবশত, জাসদ (জে,এস,ডি) নিজেদের মার্ক্সবাদী দাবি করলেও তাদের কর্মসূচি ছিল পাঁচমিশালী এবং বিভ্রান্তিকর।

সর্বহারা গণতন্ত্র ও সম্পত্তি উচ্ছেদের স্বাধীন শ্রেণিভিত্তিক কর্মসূচির বদলে তারা জাতীয় স্বাধীনতার প্রতি অনুগত তথাকথিত 'প্রগতিশীল শক্তি'র সরকার গঠনের ডাক দেয়।

তাদের যুক্তি ছিল, শ্রমিক শ্রেণি এখনও সমাজ চালানোর মতো শ্রেনীসচেতনতা রাখে না, তাই ক্ষমতা 'নিরপেক্ষ শক্তির' হাতে ন্যাস্ত করা দরকার।

জিয়াকে ক্ষমতায় বসানো হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি তাহেরসহ জাসদের নেতাদের গ্রেপ্তার করেন। ১৯৭৬-এর ২১ জুলাই তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন।

জেএসডি-র (জাসদ) নেতৃত্ব ভেবেছিল জিয়াকে "শ্রমিকদের রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে"(Political and Organisational Report: 7 November and Subsequent Events, 4th issue, 23 February 1976, p. 14)। ব্যাপারটা আসলে এমন না। বাস্তবে, জিয়া ছিলেন সুযোগ সন্ধানী এবং সুযোগের হাওয়া কোনদিকে বহে সেই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি বেঈমানের পরিচয় দিয়েছেন।

এক শ্রেণীর সাথে আরেক শ্রেণির মধ্যকার সহযোগিতা (শ্রেনীসমন্বয়তা) সর্বদাই বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই শ্রমিকশ্রেণিকে কেবল নিজের শক্তিতেই আস্থা রাখতে হবে।

এরকম সামাজিক পরিস্থিতিতে কোনো শ্রেণি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে একমাত্র ফলাফল হয় বোনাপার্টবাদী একনায়কতন্ত্র যার দ্বারা সে রাষ্ট্রের বিপ্লবী শ্রমিক, যুব এবং কৃষকদের দমন করা হয়।

তবে এই বিদ্রোহ রক্তে রঞ্জিত করে দেওয়া হয়। এটি কফিনে শেষ পেরেক ঠুকার মধ্য দিয়ে বিপ্লবী তরিকায় শুরু হওয়া ঝড়-ঝঞ্ঝার যুগের সমাপ্তি ঘটায়। জাসদ তাদের মারাত্মক ভুল বুঝতে পারে এবং তা সঠিকভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। যা দলটির রাজনৈতিক পতনের সূচনা করে।

বর্তমানে জাসদ তাদের অতীতের বিপ্লবী শ্রেণীলাইন থেকে অনেক দূরে। সেসব পূর্বের তত্ত্ব ও নীতি ত্যাগ করে তারা মন্দের ভালো স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সাথে জোট করে রাজনৈতিক বিপরীত শক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি খারাপ বিএনপি’র বিরোধিতা করতো।

জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি কঠোর কায়দায় দেশ শাসন করে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেসরকারিকরণ করে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে জোট বাঁধে। সেই সাথে জিয়া ডানপন্থী ইসলামী মৌলবাদীদের রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য উৎসাহিত করেছিল।

প্রতিবিপ্লব ভালোভাবেই জেঁকে বসেছিলো।

ইতিহাসের পৌনঃপুনিকতা

বাংলাদেশ (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) এর বাঙালিদের জাতীয় প্রশ্ন আনুষ্ঠানিকভাবে আগেই ৭১-এ সমাধান হয়েছিল। কিন্তু আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর একটি। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রের দুর্নীতিগ্রস্থ অংশের সাথে হাত মিলিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর উপর নরকের কর্মপরিবেশ চাপিয়ে দিয়েছে।

গত ৫৪ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষকে অনিচ্ছাকৃতভাবে দুটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হয়েছে: হয় বিএনপি নয় আওয়ামী লীগ!

জেমস কনোলি একবার বলেছিলেন:

"আগামীকাল যদি আপনি ইংরেজ সেনাবাহিনী সরিয়ে ডাবলিন ক্যাসেলে সবুজ পতাকা উড়ান, যদি না সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করা হয় তবে আপনার সব প্রচেষ্টা বৃথা হবে। ইংল্যান্ড তখনও আপনাকে শাসন করবে। তারা শাসন করবে তাদের পুঁজিপতি, জমিদার, ধনকুবেরদের দিয়ে এবং তাদের নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী কাজে লাগানো বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিস্বার্থান্বেষী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। তারা আমাদের শাসন করবে আমাদেরই মায়েদের অশ্রু ও শহীদদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে।"

উপোরক্ত ক্ষেত্রে দেশের নাম ও পতাকার রং পরিবর্তন করলে আপনি বাংলাদেশের যাবতীয় ঘটনাবলির ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বর্ণনা পাবেন।

আজও বাংলাদেশের বিপ্লব অসম্পূর্ণ। কিন্তু এই লাইনগুলো লেখার সময়ই একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে, আমাদের এখনকার এই অনুকূল পরিস্থিতিতেই।.

স্বাধীনতা-পরবর্তী শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশে ৭৩.৬৯ মিলিয়ন মানুষের এক অত্যন্ত শক্তিশালী শ্রমিকশ্রেণি গড়ে উঠেছে। এটি ১৯৭০ সালের পুরো পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি! শ্রেণি শক্তির ভারসাম্য এখন শ্রমিক শ্রেণির পক্ষেই।

৫ই আগস্টে ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিক শ্রেণির শক্তিশালী বাহিনী খুনি শেখ হাসিনার নৃশংস স্বৈরাচারী শাসনকে উৎখাত করেছে।

হাসিনার ১৬ বছরের ত্রাসের রাজত্ব আইয়ুব খানের মতোই পরিণতি পেয়েছে, যা ছাত্র ও শ্রমিকশ্রেনীর গণবিপ্লবের জোয়ারে ভেসে গিয়েছে। এই আন্দোলনে ছাত্ররা বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু যখন শ্রমিকরা, বিশেষ করে শক্তিশালী গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাস্তায় নামল, তখনই হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়েছে।

এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি, বিশ্বজুড়ে অনাবাসি ও প্রবাসী বাঙালিরা, বিশেষ করে ছাত্ররা তাদের বিপ্লবী ঐতিহ্য পুনরায় আবিষ্কার করেছে।

ইতিহাস ধীরে ধীরে আবারও একই দিক যাচ্ছে। কিন্তু বিজয়ের জন্য বাংলাদেশি জনগণকে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শেষবার বিপ্লব যেখানে থেমে গিয়েছিল সেখান থেকে ফের শুরু করতে হবে। বাংলাদেশের বিপ্লবের ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে, পুঁজিবাদের শাসন ভাঙা না গেলে প্রকৃত গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তি চিরকাল অধরাই থেকে যাবে।

আজ স্বৈরাচার খুনি হাসিনা বিদায় নিয়েছে। তবে ঝুঁকি আছে। কারণ এখনও বিপ্লব অসম্পূর্ণ। এই মুহূর্তে যখন আর্টিকেল লেখা হচ্ছে তখন একটি নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক উদারপন্থীরা এই সরকারের আড়ালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ন্যায্যতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। জেনারেল, উচ্চপদস্থ অফিসার, পুলিশ প্রধান ও বিচারকরা পর্দার আড়ালে ওত পেতে আছে—কখন বিপ্লবের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানা যায়।

কমিউনিস্ট হিসেবে আমরা সতর্ক করছি: পুরনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ধ্বংস না করা পর্যন্ত বিপ্লব অসম্পূর্ণ থাকবে! শ্রমিক, ছাত্র ও নিপীড়িত জনগণকে নিজ হাতে ক্ষমতা নিতে হবে। শ্রমিক-ছাত্র কমিটিগুলোকে অবশ্যই আরো বিকশিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ক্ষমতা দখল করতে হবে!

১৯৭০-এর দশকে, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের শ্রেণি সহযোগিতার লাইন গ্রহণ করার জন্যই প্রকৃত আন্দোলন ধ্বংস হয়েছিল। সুযোগ-সন্ধানী সেনাবাহিনীর জেনারেলরা প্রতিবারই গণআন্দোলনকে চূড়ান্ত আঘাত হানার মধ্য দিয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

সেই পরিণতির যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য ছাত্রদের মধ্যকার সবচেয়ে বিপ্লবী অংশকে একটি স্পষ্ট মার্ক্সবাদী কর্মসূচির ভিত্তিতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজ শুরু করতে হবে। এমন একটি লড়াকু দল তৈরি করতে হবে যারা বাংলাদেশের প্রত্যেক স্তরের শ্রমিকশ্রেণীর সাথে যুক্ত হয়ে শ্রমিকদের দিয়ে ক্ষমতা দখল ও পুঁজিবাদকে উৎখাত করার দায়িত্বকে প্রধান কাজ হিসেবে তুলে ধরবে। আমাদের এই বিশ্লেষণের সাথে একমত হওয়া প্রত্যেক বাংলাদেশি বিপ্লবীদের প্রতি আহ্বান—এই ঐতিহাসিক কাজ শুরু করতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে (Revolutionary Communist International) যোগ দিন!