বাংলাদেশঃ ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার- কোনদিকে আগাচ্ছে?

Image: Rayhan9d, Wikimedia Commons

শেখ হাসিনার সরকারের পৈশাচিক নিপীড়নের পরও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সাহসী আন্দোলন চলছে। শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো অনেকে। দুর্বল আকারে হলেও কারফিউ চলছে; ইন্টারনেট সংযোগ পুনরায় চালু হলেও ম্যাসেজিং সেবা এবং সোশাল মিডিয়া এখনো বন্ধ রয়েছে (শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, যখন এটি লেখা হচ্ছে, সরকার থেকে ঘোষণা এসেছে সোসাল মিডিয়া খুলে দেয়া হবে)। সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনের ৬ জন সমন্বয়ককে গ্রেফতার করেছে এবং চাপের মুখে তাদের দিয়ে এই বিবৃতি তৈরি করেছে যে, ছাত্রদের আন্দোলন সমাপ্ত। এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও ২৯ শে জুলাই ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট সহ সারা দেশে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। তারা আবারো নিপীড়ন ও গ্রেফতারের শিকার হয়েছে। 

যেমনটা শিক্ষার্থীরা বলেছে, এই আন্দোলনটা এখন আর কোটা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই আন্দোলনের বর্তমান লক্ষ্য শেখ হাসিনার সরকারের পতন, নিহতদের জন্য ন্যায়বিচার অর্জন এবং যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের মুক্তি। শিক্ষার্থীরা পূর্বেই নয় দফা দাবী জানিয়েছে। অনেকেই বলছে, "যখন আন্দোলন শেষ হয়, তখন বিপ্লবের শুরু" এবং তারা বর্তমান পরিস্থিতির সাথে ষাট ও সত্তরের দশকের বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামের তুলনা টানছে। এই সরকারই যে সকল সমস্যার মূলে এবং এই সরকারকে যে উৎখাত করতে হবে--- তা চিহ্নিত ও উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে এই ছাত্র আন্দোলন সঠিক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কিন্তু কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি? 

- ছাত্র আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো দিয়ে সংহত করতে হবে। গত সপ্তাহে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও জবাবদিহিতামূলক নেতৃত্বের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়েছে। হাসিনা সরকার আন্দোলনকে ধ্বংস করতে সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদেরকে দিয়ে জোরপূর্বক বিবৃতি প্রদান করিয়েছে।  সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার বা বাধ্য করার ফলে আন্দোলন যেন নেতৃত্বহীন না হয়, তা নিশ্চিত করতে সমন্বয়কদের নির্বাচিত ও প্রতিস্থাপনযোগ্য হতে হবে; এবং এই নেতৃত্ব যাতে যেকোনো সময় ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাহারযোগ্য হতে পারে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, অনুষদ এবং স্কুলের সংগ্রামী ছাত্রদের গণসমাবেশ দ্বারা, তা নিশ্চিত করতে হবে।

- ছাত্ররা একটি বৃহত্তর আন্দোলন তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু কেবল নিজেরা এই সরকারকে উৎখাত করতে পারবে না। আন্দোলনকে শ্রমিক শ্রেণির কাছে পৌছে দিতে হবে। এর শুরু হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মচারীদের আন্দোলনে যোগ দানের আহ্বান জানিয়ে। কর্মস্থল এবং শ্রমিক ও দরিদ্র পাড়াগুলোতে অ্যাকশন কমিটি গঠন করা উচিত। এগুলোকে স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় স্তরে সমন্বয় করা উচিত।

- ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের প্রতিবাদের অধিকার রক্ষা করার জন্য তাদের সেল্ফ-ডিফেন্স নিশ্চিত করতে হবে। সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈন্যদের কাছে এই মর্মে একটি আবেদন জানানো উচিত যে,  তারা যেন তাদের ভাই-বোনদের আক্রমণ না করে, উর্ধতন অফিসারদের আদেশ অমান্য করে এবং ছাত্রদের রক্ষা করে। নিম্নবিত্ত সাধারণ পটভূমি থেকে আসা সেনাসদস্যদের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সামাজিক দাবিসমূহ তুলে ধরে সেনাবাহিনীকে শ্রেণীগতভাবে বিভাজিত করার চেষ্টা করতে হবে এবং সেনাবাহিনীতে যতোটুকু সম্ভব শিক্ষার্থীদের দাবীর প্রতি সংহতি জানিয়ে কমিটি সংগঠিত করাকে উৎসাহিত করতে হবে।

- শ্রমিক শ্রেণির উপর এই আন্দোলন যদি প্রভাব ফেলতে চায়, তবে বর্তমান গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়ার পাশাপাশি একটি বিস্তৃত সামাজিক ও অর্থনৈতিক দাবির কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। গত বছর গার্মেন্ট শ্রমিকরা মাসিক ২০০ ডলারের বেতনের জন্য ধর্মঘটে গিয়েছিল। এই ধরনের দাবিগুলোকে পূর্ণাঙ্গ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, সকলের জন্য বাসস্থান এবং চাকরির অধিকার প্রভৃতি দাবীর সাথে একত্রিত করতে হবে। 

- এই ধরণের একটি কর্মসূচী গ্রহণ করা উচিত যা এই অবস্থার জন্য শুধু হাসিনার সরকারকেই দায়ী করবে না, বরং যে পুঁজিবাদী ব্যাবস্থাকে হাসিনা সরকার সেবা করে তাকেও উম্মোচন করবে। শ্রমিকদের বৃহত্তর সংখ্যায় সংগ্রামে উজ্জীবিত করতে এবং এই সামাজিক দাবিগুলো অর্জনের জন্য সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক, যার মধ্যে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ এবং বৃহত্তর জাতীয় ও বহুজাতিক পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণে জাতীয়করণ অন্তর্ভুক্ত। 

শিক্ষার্থীদের কিছু দাবী জাতিসংঘের ভূমিকাকে (যাদের সামরিক যান জন-নিপীড়নে ব্যবহার করা হয়েছে) প্রশ্ন করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করে। তারা হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবীও জানিয়েছে। কিন্তু আমরা বলবো বাংলাদেশের শ্রমিক ও শিক্ষার্থীরা শুধু বিশ্বাস করতে পারে তাদের শ্রেণি ভাই-বোনদেরকেই--- শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক আন্দোলন এবং বিপ্লবী তরুণ সম্প্রদায়। 

এই তথাকথিত 'আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়' গাজায় ইসরাইলি ম্যাসাকারকে হয় সমর্থন করেছে, না হয় "নিরপেক্ষভাবে" ও নিষ্ক্রিয়ভাবে দেখে গেছে। একদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নেতানিয়াহুকে নিয়ে আলোচনা করেই যাচ্ছে, অন্যদিকে নিরীহ ফিলিস্তিনিরা এখনো হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই আবেদন করতে হবে যাতে বাংলাদেশে চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সারা বিশ্বের বিপ্লবী শ্রমিক ও তরুণরা তাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুন করে৷ এই আবেদন সর্বপ্রথম জানাতে হবে ভারত ও পাকিস্তানের শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি, যার শুরু হবে পশ্চিম বাংলা থেকে। 

ছাত্র আন্দোলন থেকে আসা আরেকটি দাবি হল ক্যাম্পাসে সব দলীয় রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করা। এটি আওয়ামী লীগের ছাত্র শাখার গ্যাংস্টারসুলভ ভূমিকার একটি বোধগম্য প্রতিক্রিয়া এবং সমস্ত বিরোধী দল, বিশেষ করে ডানপন্থী, পুঁজিবাদপন্থী বিএনপি এবং ইসলামপন্থীদের প্রতি শিক্ষার্থীদের অবিশ্বাস প্রকাশ করে। সমস্ত বুর্জোয়া দলকে প্রত্যাখ্যান করা সঠিক। বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং শ্রমিকদের কেবল তাদের নিজেদের শক্তির উপর বিশ্বাস রাখা উচিত। তবে, প্রশ্নটি সব দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার নয়, বরং শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী রাজনীতির উপর ভিত্তি করে একটি সংগঠন গড়ে তোলার। সমস্ত পুঁজিবাদী রাজনীতি প্রত্যাখ্যানের সাথে সাথে মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন এবং ট্রটস্কির ধারণার উপর ভিত্তি করে একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আন্দোলনের সবথেকে অগ্রসর অংশের মাঝে একটি তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের নিপীড়িতদের বিপ্লবী ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।