করোনাভাইরাস সংকট নারী অগ্রগতিকে ঠেলে দিবে ৫০বছর পিছনে Share Tweetদশকের পর দশক সংগ্রাম করে নারী মুক্তির যে অগ্রযাত্রা হয়েছিল সেটিকে আবার পশ্চাতেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সময়ের মহামারী ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এই সংকটকালীন পরিস্থিতিতে সংস্কারের যে অগ্রযাত্রা হচ্ছিলো, সেটিকে পশ্চাতপদ করাই পুঁজিবাদের হাতে একমাত্র পথ। নিপীড়নের স্থায়ী অবসান ঘটাতে আমাদের প্রয়োজন সমাজতন্ত্র।এই বছর ‘সম বেতন আইন’ এর পঞ্চদশ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, যা কর্মসংস্থানগুলতে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান কর্মের শর্তাবলী এবং বৈষম্য প্রতিরোধ আইন পাশের মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কোভিড -১৯ সংকটের ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই, গত ৫০ বছরে নারীর যা অর্জন তার সিংহভাগই পশ্চাতমুখে ঠেলে দিয়েছে। পাঁচ দশকের অগ্রগতি কয়েক মাসের মধ্যেই গায়েব হয়ে গিয়েছে। এটি এ কারণে নয় যে আইনগুলো নিজেরাই গায়েব হয়ে গিয়েছে বরং সঙ্কটে জর্জরিত পুঁজিবাদ এই অগ্রগতিগুলোকে এক থাবায় পশ্চাতে ঠেলে দিয়েছে। আর এই পাঁচ দশকের অগ্রগতি যদি কয়েক মাসেই মুছে ফেলা যায়, তাহলে এটি কেবল এটাই প্রমাণ করে যে এই অধিকারগুলো পুঁজিবাদের অধীনে কতটা নাজুক।বাধ্য হয়ে গৃহবন্দীকয়েক লক্ষ নারী শ্রমিককে জোরপূর্বক পরিবারের গৃহকাজ করার জন্য ফিরিয়ে দেওয়া হয়ছে, সেই সাথে বেড়েছে পারিবারিক নির্যাতন। পারিবারিক সহিংসতা রোধে জাতীয় হেল্পলাইন গুলোতে স্বাভাবিকের তুলনায় ফোন করার হার ২৫% বৃদ্ধি পায় লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই। এবং তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে তা বেড়ে ৪৯% হয়ে যায়। অন্যদিকে, স্থায়ীভাবে কর্মচ্যুত হয়েছে প্রায় ৪৭% মায়েরা এবং ছুটিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে ১৪% নারী। পরিস্থিতির এই অবনতি মোটেও অস্থায়ী হবেনা, কারন যদি আমরা করোনা পরবর্তী বিশ্ব বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো, বিভিন্ন সেবাদান এবং খুচরা পেশাগুলোই সবথেকে বেশি ক্ষতি সম্মুখীন হবে, আর এই পেশাগুলোতেই নারী কর্মীদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মহিলারা যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল সেটিও আজ সংকটের মুখে। কিছু দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর অতিরিক্ত চাপের ফলে নারীদের আইনগত ভাবে সর্বত্র যেসব পরিষেবা গ্রহনের অধিকার রয়েছে তা নিশ্চিত হচ্ছেনা।যেমন, ইতালির বিভিন্ন হাসপাতাল শুধু মাত্র “কোভিড-১৯ হাসপাতালে” পরিণত হয়েছে যেখানে নারীদের গর্ভপাত পরিষেবা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সার্জারি সেবা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে।বহু ডাক্তার সচেতনভাবেই নারীদেরকে এই পরিষেবাগুলো দিতে আপত্তি করে। এই সংকটের কারনে হাজার হাজার ইতালিয়ান মহিলার এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি এদিকে ডানপন্থী গর্ভপাতবিরোধী রক্ষনশীল গোষ্ঠীগুলি দেশজুড়ে মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার প্রত্যাহার করার জন্য একটি অনলাইন আবেদন শুরু করেছে। তাদের স্লোগানের মাধ্যমে জানান দেয়া হচ্ছে যে, "মহামারী চলাকালীন, গর্ভপাত কোনও প্রয়োজনীয় পরিষেবা নয়"।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন আটটি প্রদেশ গর্ভপাতকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছে। টেক্সাস রাজ্যে সাধারণত বছরে ৫০,০০০ গর্ভপাত হয়। যদিও মে মাস থেকে বিশেষভাবে নির্বাচনী পদ্ধতির মাধ্যমে এই পরিষেবা সীমিত আকারে দেয়া হচ্ছে, কিন্তু তারপরেও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বেশিরভাগ নারী।সংস্কার-রদ করার সংকটএই সমস্ত ক্ষেত্র বিবেচনা করলে এটি স্পষ্ট যে, গত ৫০ বছরের নারী অগ্রগতি আজ হুমকির মুখে পড়েছে, যার ফলে শ্রমিক শ্রেণীর নারীদেরকেই এর পুরো মাশুল দিতে হচ্ছে।করোনাভাইরাস একটি এক্সিডেন্ট। যা সরকারের জন্য অপ্রত্যাছিল ছিল। কিন্তু তারপরেও, করোনাভাইরাসের সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে পুঁজিবাদের নিজস্ব নিয়মগুলো, দশকের পর দশক ধরে স্বাস্থ্য সেবায় কৃত্রিম সংকট তৈরী করে রাখা, আবাসন সংকট টিকিয়ে রাখা, সামাজিক কল্যাণের ব্যয় হ্রাস করে ফেলা, শিশুদের যত্নের ক্ষেত্রে অবহেলা, এই সবকিছু মিলে পুঁজিবাদ ইতোমধ্যেই এমন একটি মুনাফালোভী ব্যবস্থা তৈরী করে রেখেছিল যার কারনে প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ মরার উপর খরার ঘা এর মত আঘাত হেনেছে, এবং এর সর্বোচ্চ ভোগান্তিও শ্রমিক শ্রেণীর নারীদেরকেই পোহাতে হচ্ছে।শ্রমিক শ্রেণীর নারীদেরকে তাদের এসব অধিকার আদায় এবং নিজেদের ক্যারিয়ার দাঁড় করানোর জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। তবে, করোনা মহামারীর এই সংকট আবারও এটাই প্রমাণ করলো যে, পুঁজিবাদকে অক্ষুন্ন রেখে যতই "প্রগতি" সাধিত হোক না কেন, আদতে তা এই ব্যবস্থার নিপীড়ক এবং শোষক ভূমিকার ভিত্তিগত ও স্বভাবগত জায়গায় কোনও পরিবর্তন আনতে সক্ষম নয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেণীর কোনও উন্নতিকেই স্থায়ীভাবে নিরাপদ রাখতে সক্ষম নয়। পুরো ব্যবস্থাটি এখন যে সংকটের মুখে পতিত হয়েছে, এই সংকট মোচনের জন্য মালিকশ্রেণী অতীতের সকল সংস্কারকে রদ করবে।সমাজতন্ত্র ও মুক্তিসত্যিকারের নারী সমতা পুঁজিবাদের অধীনে কখনই অর্জন করা যাবে না। যে কোনও অগ্রগতি স্থায়ী করবার জন্য আমাদের গণতান্ত্রিকভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি দরকার যা বৈষম্য ও নিপীড়ন অবসানের জন্য একটি বস্তুগত ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম। সেটি এমন একটি অর্থনীতি যা মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বা একটি নিদির্ষ্ট শ্রেণীর মুনাফার উপর নয়, বরং জনগণের প্রয়োজনের ভিত্তিতে চালিত হবে।প্রয়োজনীয় সম্পদ সকলের কল্যাণে বরাদ্দ করা হবে, গৃহকর্মের বোঝা অপসারণ করার জন্য প্রয়োজনী গবেষণা তহবিল গঠন করা হবে। সকলধরনের স্বাস্থ্যসেবা এমনকি গর্ভপাতের সুবিধাও সবাইকে প্রদান করা হবে।স্বাস্থ্যসেবার খাতকে মুনালোভীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে এটিকে সর্বোচ্চ পরিমানে ক্ষতির সম্মুখে ঠেলে দেয়া যার ফলে এটি একেবারে ভেঙে পড়ে এবং তার কড়াল গ্রাসে শ্রমিক শ্রেণীর নারীরা পতিত হয়, এমন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেয়া হবে। সর্বত্র যথেষ্ঠ পরিমাণে স্বাস্থ্যসেবা যাতে সবার জন্য নিশ্চিত করা যায় এমন কল্যাণমুখী নীতিমালা প্রনয়ণ করা হবে যাতে করে কোনও মহামারীর মুখেও মানুষ স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত না হয়।নারীরা অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবেনা। পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে যেকোনোও নারীকে এর বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণে ফ্রি পরিষেবা দেয়া হবে এবং দরকার হলে অন্যত্র বাসস্থানের ব্যবস্থাও করে দেয়া হবে। বৈষম্য এবং নিপীড়ণের বস্তুগত ভিত্তিকে যখন বিলুপ্ত করে দেয়া হবে, তখন নারী বিদ্বেষ, লিঙ্গবৈষম্য এবং গোঁড়ামিও ধীরে ধীরে বিলীন হতে শুরু করবে যার চূড়ান্ত পরিণতি হবে এসবের স্থায়ী বিলুপ্তি।নারী অধিকারের সংগ্রাম- নারী সমতার সংগ্রাম- সমস্ত মানবসভ্যতার মুক্তির জন্যই সংগ্রামঃ অর্থাৎ এটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবেরও সংগ্রাম!বর্তমানের মহামারী সংকট এবং অর্থনৈতিক ধ্বস গত কয়েকদশকে নারীমুক্তির অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সংকটকালীন মুহূর্তে পুঁজিবাদ সংস্কার-রদের এরকম ভূমিকাই নিয়ে থাকে সাধারণত। এই নিপীড়নের স্থায়ী সমাধানের জন্য আমাদের প্রয়োজন সমাজতন্ত্র।মূল লেখার লিংক